
আজ ৩৬ জুলাই—বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক স্মরণীয় মাইলফলক। এই দিনে জনগণের অন্তরে জমে থাকা দীর্ঘকালীন নীরব প্রতিবাদ রূপ নেয় এক সুসংগঠিত গণজাগরণে, যা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশক্তির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বকে ভেঙে দেয়। সেই গণপ্রতিরোধের মুখে শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন, এবং এর সঙ্গে অবসান ঘটে দীর্ঘ ১৬ বছরের দুর্বৃত্তায়িত শাসনের। এক বছর পর, এই দিনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—৩৬ জুলাই কেবল একটি সরকারের পতনের দিন নয়, বরং এটি নাগরিক চেতনার নবজন্ম এবং রাষ্ট্রচিন্তার এক নতুন যাত্রাপথের সূচনাবিন্দু।
ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন কখনো আকস্মিক নয়—তার আগে সমাজের গভীরে গড়ে ওঠে এক দীর্ঘস্থায়ী নীরব প্রতিরোধ, যা ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক সচেতন নৈতিক প্রস্তুতিতে। বিশ্ব ইতিহাসে আমরা এই ঘটনাপঞ্জি বারবার দেখেছি: জার্মানিতে নাৎসি পতনের আগে, ইতালিতে মুসোলিনির উচ্ছেদের প্রাক্কালে, কিংবা লাতিন আমেরিকার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে—সর্বত্র মানুষের হৃদয়ে সঞ্চিত নীরব প্রতিবাদ ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে গণজাগরণে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ছিল একই চিত্র। রাষ্ট্রীয় দমন, গুম, বাকস্বাধীনতার হরণ, প্রশাসনিক দলীয়করণ এবং সামাজিক শাসনের নানা কৌশলের মধ্যেও নাগরিকদের চেতনায় এক ধরণের অপ্রকাশিত প্রতিরোধ জন্ম নিচ্ছিল। এ দেশের মানুষ ভয়কে স্বাভাবিক জীবনের অংশ মনে করে নিতে নিতে যখন আর নিতে পারছিল না, তখনই জন্ম নেয় নতুন প্রশ্ন—কেন রাষ্ট্র এমন হবে? কেন নাগরিক কণ্ঠ রুদ্ধ থাকবে? সেই প্রশ্নগুলোই পরিণত হয় নতুন রাষ্ট্রচিন্তার বীজে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৩৬ জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে।
এই বিস্ফোরণ ছিল কোনো আকস্মিক রাগ বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়—বরং দীর্ঘ সময় ধরে চলা দলীয় অনুগত্যে পরিচালিত প্রশাসন, নিয়ন্ত্রিত বিচারব্যবস্থা, সেন্সরড সংবাদমাধ্যম, পাঠ্যবইয়ের একমুখীকরণ এবং নাগরিক অধিকারের চরম সংকোচনের বিরুদ্ধে এক চিন্তাশীল, ধৈর্যশীল প্রতিরোধ। এই অভ্যুত্থান তাই কেবল একটি সরকারের পতন নয়—এটি একটি যুগপৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের নাম, যা মানুষকে রাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
এই গণপ্রতিরোধ কেবল রাজনৈতিক দলীয় কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না, বরং নাগরিক সমাজের প্রত্যন্ত কোণ থেকে উঠে আসা ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের সম্মিলনেই এটি পূর্ণতা পায়। যারা সরাসরি রাজপথে ছিল না, তারাও নিজস্ব পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের দমননীতির বিরোধিতা করেছে। কেউ তাঁদের সৃষ্টিশীল চর্চায় তুলে ধরেছেন শোষণের বয়ান, কেউ ফেসবুক পোস্টে উচ্চারণ করেছেন প্রতিবাদী বাক্য, আবার কেউ চুপচাপ থেকে প্রতিদিনের জীবনে গড়ে তুলেছেন নৈতিক প্রতিরোধের ব্যারিকেড।
এই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের বহুমাত্রিকতা—সংগীত, কবিতা, চিত্রকলা কিংবা নাটিকা—রাষ্ট্রশক্তির একমুখী ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করে তুলে ধরে একটি বিকল্প বয়ান। ফলে রাষ্ট্রশক্তির একতরফা কর্তৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং গঠিত হয় একটি অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রের সম্ভাব্য ধারণা। এখানেই প্রতিরোধের প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত—এটি ছিল ব্যক্তি ও সমষ্টিক প্রতিবাদের এক যুগপৎ বহিঃপ্রকাশ।
যদিও গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী মুহূর্তে দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি জাতীয় বিপ্লবী সরকারের—যে সরকার অতীতের অন্যায়, দমন ও দুর্নীতিকে মুছে দিয়ে নতুন রাষ্ট্রচিন্তার রূপরেখা দেবে। কিন্তু ভেতরে-বাইরের জটিল চক্রান্ত, রাষ্ট্রের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক চাপ ও রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের কারণে সেই স্বপ্ন পূর্ণতা পায়নি। এর পরিবর্তে গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস—একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও নোবেল বিজয়ী আস্থাবান ব্যক্তিত্ব। তিনি আজ ৩৬ জুলাইয়ে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’-এর মাধ্যমে জনগণের সেই আস্থার উত্তরদানের পথে এগিয়ে চলেছেন। এই ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ঐকমত্য কমিশনের ভিত্তিতে গৃহীত সংস্কার প্রস্তাবগুলো—যা ৬২টি বিষয়ের ওপর দলীয় সমঝোতা এবং ৮টি মৌলিক কাঠামোগত সংস্কারের ভিত্তিতে নির্মিত। এর মধ্যে রয়েছে: প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের সীমা নির্ধারণ, সংসদীয় এলাকা পুনর্বিন্যাস, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক কাঠামো, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, সংবিধানের পুনর্মূল্যায়ন এবং নাগরিক অধিকারের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। এসব উদ্যোগ শুধুই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়—এগুলো এক নতুন রাষ্ট্র কল্পনার ভিত্তি।
যদিও আগামী দিনের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, তবুও আজকের এই দিনটি আমাদের সামনে একটি নতুন রাষ্ট্রের সম্ভাবনার রূপরেখা তুলে ধরে—যেখানে অংশগ্রহণমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক শাসনের বীজ রোপণ করা হয়েছে। এই বীজ যাতে অঙ্কুরিত হয়, তার দায়িত্ব এখন নাগরিক সমাজের, রাজনৈতিক নেতৃত্বের এবং রাষ্ট্র কাঠামোর অভ্যন্তরে থাকা নীতিশীল অংশের ওপর।
তবে এই পথ নিঃসন্দেহে সুগম নয়। পতিত মাফিয়াতন্ত্রের দীর্ঘ ছায়া এখনো আমাদের রাজনীতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সেই সঙ্গে রয়েছে পরাজিত গোষ্ঠীর প্রতিশোধপরায়ণ নীলনকশা, যারা দেশের ভেতরে-বাইরে নানা চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পুরনো শাসন কাঠামোকে ফিরিয়ে আনতে মরিয়া। একদিকে বিদেশে পলাতক নেতৃত্ব, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে ছদ্ম-গণতন্ত্রের দোসররা—সব মিলে এ উত্তরণকে বিপদাপন্ন করার প্রচেষ্টা চলছে।
আজকের দিনে বুঝে নিতে হবে—ফ্যাসিবাদ এখন আর কেবল গুম, খুন বা ভোট ডাকাতির মতো কৌশলে আবদ্ধ নয়; বরং এটি এক ধরনের মতাদর্শিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যা নাগরিকদের স্বপ্ন, প্রশ্ন ও প্রতিবাদকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। প্রশাসনের ভেতরে এখনো কিছু অংশ এই নিয়ন্ত্রণের বাহক হিসেবে সক্রিয়। এদের চিহ্নিত ও প্রতিরোধ না করা গেলে, এই উত্তরণ দুর্বল হয়ে পড়বে, আর জনগণের রক্ত-ঘামে অর্জিত বিজয় প্রশ্নের মুখে পড়বে।
৩৬ জুলাইয়ের বিজয় কেবল অতীতের একটি ঘটনার স্মরণ নয়—এটি ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি, যেখানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থান ছিল জাতীয় ঐক্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন—যেখানে ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবী, প্রবাসী, সাংবাদিক, শিল্পী ও রাজনৈতিক দলসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একত্রে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে। সেই ঐক্য এখন আরও প্রয়োজন—রাষ্ট্রকে নতুন ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হলে আমাদের সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের দেশে এখন এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজন, যা গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক এবং নাগরিক অধিকারকে সর্বোচ্চ সম্মান জানায়। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করি, তা হচ্ছে ‘‘বাংলাদেশপন্থা’’—একটি ধারণা, যা দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলে। ‘‘বাংলাদেশপন্থা’’ হচ্ছে জনগণের মৌলিক অধিকার, তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রামের প্রতীক, যেখানে জনগণই রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি এবং রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণের কল্যাণে কাজ করবে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেই চেতনাকে জারি রাখা এবং তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই অন্তর্বর্তী সরকারকে যারা তথাকথিত ‘সুশীলতার’ মুখোশে ব্যর্থ প্রমাণ করতে চায়, তারা মূলত সেই পুরনো ফ্যাসিবাদী শাসনের দোসর। অতীতে যারা গুম, দমন, বাকস্বাধীনতা হরণে নীরব থেকেছে, তারাই আজ গণতন্ত্রের নতুন যাত্রার পথে বিঘ্ন ঘটাতে চায়। এদের চিহ্নিত করতে হবে, জনগণের আশার রাজনীতিকে হাইজ্যাক করতে দেওয়া যাবে না।
নাগরিকের সম্মিলিত প্রশ্ন, নৈতিক প্রত্যয় এবং সক্রিয় অংশগ্রহণই আগামী দিনের বাংলাদেশকে গড়ে তুলবে এক ন্যায়নিষ্ঠ, সাংবিধানিক এবং টেকসই রাষ্ট্রব্যবস্থার পথে। এখনই সময়—৩৬ জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে বহন করা, রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের মালিকানাকে নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ থাকা।
লেখক,
সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান,
ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (DIU)