
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে বৈষম্যবিরোধী লিয়াজোঁ কমিটিতে ছিলেন। ৫ আগস্টের পর সরকার গঠনেও দায়িত্ব পালন করে এ কমিটি। ভেতরে থেকে অভ্যুত্থানকে দেখেছেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, অভ্যুত্থানে ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ছিল। পরিচয় জেনেই শিবির নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। অভ্যুত্থানে তাদের সহায়তার চেয়ে কৃতিত্ব বেশি দাবি করা হচ্ছে। অভ্যুত্থানের সামনে এবং নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের শত্রু হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ৩ আগস্ট সরকারের পতন নিশ্চিত হলেও ধারণা ছিল, আরও আট-দশ দিন টিকবে। ততদিন টিকলে হাসিনা পালাতে পারতেন না। ৫ আগস্টের পর যোগাযোগ হয় বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি রাজীব আহাম্মদ।
সমকাল: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটিতে ছিলেন। ভেতর থেকে সব দেখেছেন। জুলাইয়ের ইতিহাস নিয়ে এখন অনেক রকম কথা শোনা যাচ্ছে। আসলে ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট কীভাবে আন্দোলন হয়েছিল?
নাসীরুদ্দীন: আলোচনা ব্যক্তি পর্যায়ে নিতে চাই না। সামগ্রিকভাবে অনেক মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। যখনই ক্যাম্পাসে আন্দোলন করতাম, সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বাম সংগঠন ছিল। ছাত্রশিবিরে যারা ছিল, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। শিবির যদিও প্রকাশ্য রাজনীতি করত না, তাদের তো সক্রিয় কার্যক্রম ছিল।
সমকাল: কারা শিবির– এটা জেনেই তো তাদের সঙ্গে ছিলেন?
নাসীরুদ্দীন: জুলাইয়ে সবাই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ছিলাম। আমাদের সবার পরিচয় ছিল– নিপীড়িত। নিপীড়িত পরিচয় থেকে ঐক্যবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। পারস্পরিক সম্মান ছিল সবার। যে কেউ শিবির করতে পারে, কেউ বাম করতে পারে, কেউ ডান করতে পারে।
সমকাল: বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ কখন হলো?
নাসীরুদ্দীন: ২০২৩ সালে ছাত্রশক্তি তৈরির উদ্দেশ্য ছিল রাজনীতি ছাত্রদের হাতে আনা। ছাত্রশক্তির মতো সংগঠন পৃথিবীতে কমই আছে,
যার মাতৃ সংগঠন নেই। ফলে ছাত্ররাই গণঅভ্যুত্থান ঘটায়। এর পর জাতীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
সমকাল: ৫ আগস্টের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগ ছিল না?
নাসীরুদ্দীন: ছোট ছোট দল যেমন এবি পার্টি, গণতন্ত্র মঞ্চ; তারা আসত যখন আমরা ক্যাম্পাসে নিপীড়িত হতাম। সংহতি জানাত। তাদের সঙ্গে এতে হৃদ্য গড়ে ওঠে। বিএনপির দলীয় প্রধান বা জামায়াতের দলীয় প্রধান, তাদের সঙ্গে এটা ছিল না।
সমকাল: তাহলে ১৯ জুলাই নাহিদ ইসলাম যে ৪ দফা দিয়েছিলেন, তা কোনো দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই দিয়েছিলেন? অথবা সেদিন রাতেই আরেক সমন্বয়ক আবদুল কাদেরের পাঠানো ৯ দফাও আলোচনা ছাড়াই হয়েছিল?
নাসীরুদ্দীন: ১৯ জুলাই রাতে নাহিদ গুম হয়। রাতে আমরা ফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। যারা ক্যাম্পাসে ছিল তারা ৯ দফা প্রস্তুত করেছিল। ধরপাকড়ের কারণে আমরা রাজধানীর বেরাইদ চলে যাই। আবদুল কাদেররা তখন ৯ দফা তৈরি করে সংবাদমাধ্যমে পাঠায়। আমি, নাহিদ, আমরা আলোচনা করে চার দফা তৈরি করে সংবাদমাধ্যমে পাঠাই। কাদেরের সঙ্গে কথা হলে জানায়, ৯ দফা পাঠিয়ে দিয়েছে। ৯ দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পর একটা ছবিও তুলিনি। তখন ভাবছিলাম, সরকার কীভাবে বানাব। এখন সবাই ৫ আগস্ট উদযাপন করছে। আমি চিন্তা করছি নির্বাচন নিয়ে। শুধু এনসিপি না, দেশের সংকট হতে পারে নির্বাচনে।
সমকাল: ২১ জুলাই হত্যাযজ্ঞ থামল। আপনারা তখন নজরবন্দিতে। এর পরের দিনগুলোর আন্দোলন কীভাবে চলল? আন্দোলনের নেপথ্যে থাকায় বোধ হয় আপনাকে ও মাহফুজ আলমকে গুম-গ্রেপ্তারের শিকার হতে হয়নি।
নাসীরুদ্দীন: এখন খুব বিতর্ক হচ্ছে, পেছনে থাকা মানুষ আর সামনে থাকা মানুষ নিয়ে! মনে হচ্ছে পরস্পরের শত্রু! এ পরিস্থিতিটা কেন হলো? যারা পেছনে ছিলেন, তারা ভাবছেন, তাদেরকে ইতিহাস থেকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেকে তাই সামনে আসতে চাইছেন। আন্দোলনের ইতিহাসে এককভাবে শিবির যে পর্যায়ে নিতে চায়, তা সত্য বিষয় নয়। তবে শিবিরকে ধন্যবাদ, তারা অনেক ভালো সহায়তা দিয়েছে। ১৫ বছরের নিপীড়নে ওদের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে। তারা সবচেয়ে নির্যাতনের শিকার ছিল।
সমকাল: ২৬ জুলাই সামনের সারির সমন্বয়কদের তুলে নিল ডিবি। তারপর কাদের, মাহিন, রিফাতরা সেফ হাউসে গেলেন। আপনারা আরেক জায়গায় রইলেন। স্তিমিত হতে থাকা আন্দোলন আবার কীভাবে জাগল?
নাসীরুদ্দীন: আন্দোলন থামেনি। ওপরে ওপরে স্বাভাবিক হলেও ভেতরে আগুন ছিল। সরকারও যখন এটাতে একটু নমনীয় হয়েছে, তখন ওই ফাঁদে পড়েছে। তখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছিল।
সমকাল: শেখ হাসিনা আপনাদের সঙ্গে সরাসরি যোগ করেননি?
নাসীরুদ্দীন: আমরা গোয়েন্দাদের চোখে ধুলা দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা বলেছিলাম বসব, মেনে নেব, বেশি কিছু করব না, চলে যাব। জুলাইয়ের শেষ দিকেও মন্ত্রীরা, ডিজিএফআই আলোচনার কথা বলল। তখনও বলেছি, ঠিক আছে বসছি। বসে তাদেরকে বলেছি, ঠিক আছে কালকে থেকে কিছু বলব না। কিন্তু পরে প্রেস কনফারেন্স করে ফেলছি। গোয়েন্দা সংস্থাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলতে হতো।
সমকাল: আপনারা পরবর্তী সময়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে স্পষ্ট– ৩ আগস্টেই বুঝতে পেরেছিলেন, হাসিনা থাকছেন না। এটা কি মাঠের তথ্য? নাকি অন্য কোথা থেকে আসা? যেমন আওয়ামী লীগ বলে থাকে, বিদেশি ষড়যন্ত্রে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। আপনারা কি বিদেশি সূত্র থেকে ধারণা পাচ্ছিলেন?
নাসীরুদ্দীন: হাসিনার পতনের নিশ্চয়তা মাঠ থেকেই এসেছিল। আমরা জানতাম, আর কতটুকু ধাক্কা দিলে সরকার পড়ে যাবে। ৩ আগস্ট পর্যন্ত মানুষের যে প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তাতে সরকারের টেকার উপায় ছিল না। তবে ভেবেছিলাম, আরও কয়েক দিন টিকতে পারে। ৫ আগস্ট হাসিনা চলে যাবে– এ প্রস্তুতি ছিল না। ভেবেছিল, আরও আট-দশ দিন সরকার টিকবে। টিকলে হাসিনা হেলিকপ্টার দিয়ে যেতে পারত না। তার তো জেলে থাকার কথা ছিল। অনেকে মনে করে, তাকে বিদায়ের পথ করে দেওয়া হয়েছে এবং আমরাও অনেক জায়গায় চুপ ছিলাম। কারণ রক্ত কিন্তু ঝরছিল। আবার অনেকেই আর রক্ত দেখতে চায়নি। ২৯ জুলাই থেকে চাপ ছিল– রক্ত বন্ধ করতে হবে।
সমকাল: কারা চাপ দিয়েছিলেন?
নাসীরুদ্দীন: নামগুলো না বলি। অনেক মানুষই যারা নেতৃত্বে ছিল...।
সমকাল: ৬ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কেন একদিন এগিয়ে আনলেন? বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একবার বলেছেন, তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলে ছাত্ররা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৫ আগস্ট নিয়ে আসে।
নাসীরুদ্দীন: সত্য না। ৪ আগস্ট আমি, নাহিদসহ অন্যরা শাহবাগে ছিলাম একটা অফিসে। ওই দিন দুপুরে খবর ছড়ায়– আবার কারফিউ জারি হবে। এতে সবাই শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তখন অনেকে বলল, ‘আজকেই গণভবনের দিকে রওনা দিই।’ আমি হিসাব করে দেখি, ছাত্র-জনতার জমায়েত বড়জোর ৩০-৪০ হাজার। এত কম মানুষ নিয়ে যাওয়া আসলে আত্মহত্যা হবে। তখন আলাপ আসে, ৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা হবে। আবার চিন্তা ছিল কারফিউ হলে লোকজন ঢাকায় আসতে পারবে না। কারণ রাস্তা তো আমরাই বন্ধ করে রেখেছি। তাই এগিয়ে আনা হয়।
সমকাল: আর ৫ আগস্ট?
নাসীরুদ্দীন: একদম ভোরে একটা ভিডিও বার্তা পাঠাই আলজাজিরা ও সিএনএনে। ওই সময় আমরা প্রত্যেকে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। যদিও ৪ আগস্ট রাতে খবর পাই, বিভিন্ন বাহিনী ভাগ হয়ে গেছে।