ছোট একটি রুম। এতে নেই কোন জানালা। একটি দরজা রয়েছে, তাও ভাঙ্গা। রুমে আলো-বাতাস ঢোকার কোন জায়গা নেই। তাই দিনের বেলাতেও রুমটিতে থাকে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। রুমটি কবে রং করা হয়েছে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। দেয়ালের আস্তর খসে পড়ছে। রুমের মধ্যেই রান্না করে খেতে হয়। রুমের সামনে জমে আছে ময়লা পানি। সেই পানিতে পা ভিজিয়ে প্রবেশ করতে হয় রুমে।
বলছিলাম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ ঝালমুড়ি বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম অপুর (৫৬) পরিবারের কথা। তিনি ৫ আগস্ট রাতে রাজধানীর কোতোয়ালি থানার গোলকপাল লেন এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। এই বাসাতেই ৬ হাজার টাকায় ভাড়া থাকছেন অপুর পরিবার। তিনি শহিদ হওয়ার পর এখনও তার পরিবারের সদস্যরা সেখানেই থাকছেন। বাসাটি ৩৫ নং ওয়ার্ডের (বংশাল থানার পেছনে) ৭ নং গলির গোলকপাল লেনে।
সরেজমিনে বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বংশাল-নবাবপুর মেইন রোড থেকে সেই বাসায় যাওয়ার জন্য চিকন একটি রাস্তা। সেখান দিয়ে রিকশা যাওয়ার কোন উপায় নেই। বাসায় একটি মাত্র রুম। রুমে নেই কোন খাট, আলমিরা, এমন কি নেই কোন আসবাবপত্র। আছে শুধু একটি মাদুর বিছানো। রুমের মধ্যে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। সেখানেই রাতে থাকেন শহিদ মনিরুল ইসলামের স্ত্রী আমেনা বেগম (৫২) ও বড় সন্তান রবিউল ইসলাম শাওন (২৪)। তাদের রাতে থাকার জন্য নেই কোন লেপ বা তোষক। এই শীতের মধ্যেও তাদের এই ভাবেই কাটছে রাত।
শহিদ মনিরুল ইসলাম অপুর বড় ছেলে শাওন বলেন, আসবাব পত্র, খাট ও আলমিরা কয়েকটা ছিল। কিন্তু আব্বা শহিদ হওয়ার পর তা বিক্রি করে ঘর ভাড়া দিয়েছি। এখনও ঘর ভাড়া বাকি। কোন দিন এক বেলা, কোন দিন দুই বেলা খেয়ে দিন চলছে আমাদের। শুনছি অনেক পরিবার অনেক সহযোগিতা পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের অবস্থা সব থেকে খারাপ। অথচ আমরা এখনও কিছু পাইলাম না।
সম্প্রতি রাজধানীর কোতোয়ালি থানার ৩৫ নং ওয়ার্ডের ৭ নং গোলকপাল লেনের ভাড়া বাসায় এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপ হয় শহিদ মনিরুল ইসলাম অপুর স্ত্রী আমেনা বেগম ও ছেলে শাওনের সাথে।
মনিরুল ইসলাম অপুর বাড়ি চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার নতুন বাজার থানায় হলেও তিনি বড় হয়েছেন ঢাকাতেই। বাবা ফজল ব্যাপারী ও মা শহর বানু মারা গেছেন অনেক বছর আগে। মনিরুল ইসলামরা ছিলেন পাঁচ ভাই। তার মধ্যে চার ভাই মারা গেছেন। যে একজন বেঁচে আছেন তিনি থাকেন চাঁদপুরে।
মনিরুল ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী আমেনা বেগমের ঘরে দুটি সন্তান ছিল। ছোট ছেলে মুন্না ইসলাম ২০২০ সালে ওয়ারিতে কিশোর গ্যাং এর হাতে নিহত হয়। মনিরুলের প্রথম সংসারে স্বপ্না (২৮) নামে একটি মেয়ে ও রিয়াদ ইসলাম (১৭) নামে ছেলে সন্তান রয়েছে।
মনিরুল ইসলাম ৫ আগস্ট শহিদ হলেও তাকে ৬ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরে অবশ্য ১৭ ডিসেম্বর ময়না তদন্তের জন্য লাশ উত্তোলন করা হয়। ময়না তদন্ত শেষে ওই দিন রাতেই আবার লাশ দাফন করা হয়।
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে। এ খবর শোনার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ উল্লাস শুরু করে। তবে সারাদেশে যখন চলছিল বিজয় উৎসব, তখনও বংশাল চৌরাস্তায় চলমান ছিল পুলিশ ও সাধারণ জনতার মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং গোলাগুলি। এর একপর্যায়ে গোলকপাল লেনের মুখে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঝালমুড়ি বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম অপু।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অকূলপাথারে পড়েছেন শহিদ মনিরুল ইসলামের স্ত্রী ও সন্তান। শাওন আগে একটি গ্যারেজে কাজ করলেও বাবা মারা যাওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, তাই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে শাওন বলেন, ৫ আগস্ট সারাদিন ঝালমুড়ি বিক্রি শেষে সন্ধ্যার আগে আব্বা বাসায় আসেন। এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এশার নামাজ পড়তে বের হন। তখনও বংশাল চৌরাস্তায় পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং গোলাগুলি চলছিল। আব্বা মাত্র লোহার গেটের সামনে দাঁড়ান, তখনই একটা গুলি এসে আব্বার পেটে লাগে। তিনি সেখানে পড়ে যান। একটু পরে মহল্লার লোকজন আমাদের খবর দেয়, আমি গিয়ে দেখি আব্বার পেট থেকে অনেক রক্ত বের হচ্ছে। আমি তখন আমার জামা খুলে পেটে বাঁধি এবং মেডিকেলে নেওয়ার চেষ্টা করি।
তিনি বলেন, বংশাল চৌরাস্তায় তখনও অনেক গোলাগুলি চলছিল। এর মধ্যে আমি আব্বাকে মেডিকেলে কিভাবে নেবো? পরে মহল্লার একজনের কাছ থেকে একটি ভ্যান গাড়ি চেয়ে নিয়ে আব্বাকে ভেতরের রাস্তা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে এসে দেখি আমার ভ্যানটি নেই, চুরি হয়ে গেছে।
নিজের পাসপোর্ট দেখিয়ে রবিউল ইসলাম শাওন বলেন, আমাকে আব্বার বিদেশে পাঠানোর ইচ্ছা ছিল। এই জন্য আমার পাসপোর্ট করা ও মেডিকেলও করা হয়েছিল। কিন্তু তা আর আমার হবে না। আমাকে কে টাকা দেবে? সংসারের হাঁড়িই চলে না। বাড়ি ভাড়া বাকি পাঁচ মাসের। বাড়ির মালিক বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন। এখন কি করবো তাই ভাবছি।
সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শহিদ মনিরুলের স্ত্রী আমেনা বেগম বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর আমার স্বামী ভেবেছিলেন সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর গোলা-গুলি হবে না কোথাও। কিন্তু সেই দিন গভীর রাত পর্যন্ত বংশাল চৌরাস্তায় গোলা-গুলি হলো। খবর শুনে ছুটে যাই লোহার গেটে। গিয়ে দেখি আমার স্বামী পড়ে আছে। অনেক রক্ত বের হচ্ছে। আমি আমার স্বামীকে পানি খাওয়াই। পরে আমার ছেলে ওর বাবার লাশ ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, ঝালমুড়ি বিক্রি শেষ করে সন্ধ্যার দিকে আমার স্বামী বাসায় আসে। বাসায় যা ছিল তা দিয়ে খেতে দেই। খাওয়া শেষে বলেন, এশার নামাজ পড়তে গেলাম। আর বাইরের অবস্থাটাও একটু দেখে আসি। এই বলে সে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এর একটু পরে খবর আসে তার শরীরে গুলি লাগছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে আমেনা বেগম বলেন, আমি রাজনীতি করিও না, বুঝিও না। আমরা সাধারণ মানুষ। স্বামীকে হারিয়েছি। কয়েক বছর আগে ছোট ছেলেডারে হারিয়েছি। আমার পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ। কিভাবে চলবে আমার সংসার? বাসাভাড়া পাঁচ মাস বাকি, কিভাবে পরিশোধ করবো? বাড়ির মালিক বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন। ছেলেডারে নিয়ে কোথায় যামু? ছেলেটা বাবা ও ভাইকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেছে। এখনও সরকার বা জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে কোন সাহায্য দেয় নাই। শুধু বলে এই কাগজ লাগবে, সেই কাগজ লাগবে। শাওন সেই কাগজ পত্র সংগ্রহ করতে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করছে। এ কারণে সে কাজও করতে পারছে না। এখন সংসারডা কীভাবে চলে?
রবিউল ইসলাম শাওন বলেন, আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই। যারা আমাকে বাবাহারা করেছে আমি তাদের বিচার চাই। যে পুলিশ আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছে, আমাকে এতিম করেছে, মাকে বিধবা করেছে তার বিচার চাই। সরকারের প্রতি আহবান জানাই, আমাদের পরিবারের জন্য যেন এটা ব্যবস্থা করা হয়, যাতে আমরা কোন রকমে খেয়ে পরে বাঁচতে পারি।
তিনি বলেন, আমার বাবা মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো পূরণ হবার নয়। তবে সরকার যদি আমার একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে মা’কে নিয়ে কোনভাবে আমি বাঁচতে পারতাম।
শাওনের মা আমেনা বেগম বলেন, আসলে সেদিনের অবস্থা ও কষ্টের কথা বলা খুবই কঠিন। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আর কোন পরিবারকে যেন এমন সমস্যায় পড়তে না হয় আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি জানান, আমার ও ছেলেটার নিরাপদ ভবিষ্যত চাই। শাওনের জন্য একটা চাকরি চাই। মহল্লার মানুষের কাছে শুনি সরকার বিভিন্ন শহিদ পরিবারকে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। আমরা তো কোন সহযোগিতা পাই নাই। সরকার অবস্থা বিবেচনা করে যেন আমাদের সহযোগিতা করে।
শহিদ মনিরুল ইসলাম অপুর শ্যালক মো. খোকন বলেন, এই পরিবারের শুধু দুলাভাই আয়-রোজগার করতো। এদের তো আর দেখার কেউ নেই। আমার আপা ও ভাগিনাটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমি যেটুকু পারি সাহায্য সহযোগিতা করছি। আমি চাই সরকারের পক্ষ থেকে যেন এই অসহায় পরিবারটির জন্য যেন কিছু করা হয়।