Image description

নূরজাহান বেগম। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা। ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রশাসন, প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক কর্মসূচির মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকও। আপাদমস্তক একজন ব্যাংকার সামলাচ্ছেন দেশের স্বাস্থ্যখাত। আছে নানান সমালোচনা। তবে তিনি এগুলো ‘কেয়ার’ করেন না। নীরবে কাজ করে যাওয়াই তার পছন্দ।

এক বছরে তার কর্মমূল্যায়নে উঠে এসেছে বিশাল ফিরিস্তি। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সালাহ উদ্দিন জসিম

সাক্ষাৎকারে নূরজাহান বেগম জানিয়েছেন, কী কারণে আসেন না মিডিয়ায়। আক্ষেপ করে বলেন, ‘সব জায়গায় অরাজকতা, তবু চেষ্টা করে যাচ্ছি। সহকর্মীদের অধিকাংশ স্লো, জুজুর ভয়, মানিয়ে চলার মানসিকতাসহ নানান কারণে নির্ভীকভাবে কাজ করা খুব কঠিন। আরও কঠিন নির্দলীয়, সৎ ও দক্ষ লোক পাওয়া।’

তারপরও আত্মবিশ্বাসে উৎরে গেছেন—জুলাই শহীদ-আহতদের তালিকা প্রণয়ন, এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) ৮০ শতাংশ মেডিসিন সরবরাহে সক্ষমতা অর্জন এবং লুটপাট-অনিয়ম থামাতে ডিজিটালাইজেশনে নজর দেওয়ার কাজে।

 

জাগো নিউজ: একটি রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আপনারা সরকারে এসেছেন। প্রথমদিকের চ্যালেঞ্জ কী ছিল?

নূরজাহান বেগম: বড় চ্যালেঞ্জ ছিল শহীদ ও আহতদের তালিকা করা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো হয়নি। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসেও এটি নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের ক্ষেত্রে সেটা যাতে না হয়, সেই চ্যালেঞ্জ আমরা নিয়েছি।

৫ আগস্টের আগে হাসপাতালে রোগীদের তথ্য ও রেজিস্টার ঠিকমতো সংরক্ষণ করা হয়নি। অনেক আহত ব্যক্তি ভয়ে তাদের সঠিক তথ্য, ফোন নম্বর লিপিবদ্ধ করেননি। কেউ কেউ এক জায়গায় কয়েক দিন চিকিৎসা নিয়ে আরেক জায়গায় চলে গেছেন। এসব কারণে তালিকা করার কাজটি কঠিন ছিল, কিন্তু আমরা এসে শুরুতেই কমিটি করে সব তথ্য সংগ্রহ করেছি। পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নে কাজ করেছি।

প্রথমে আহতদের চিকিৎসা ও শহীদ পরিবারে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করি এবং শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিচিতিসহ একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করি। গঠিত কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত/শহীদদের তালিকা ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করে। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে তালিকা চূড়ান্তভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়।

 

জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এখন পর্যন্ত আহত ১৩ হাজার ৮১১ জনের নাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। গেজেটে প্রকাশিত ভেরিফায়েড আহতের সংখ্যা ১২ হাজার ৪২ জন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের তালিকা এমআইএসের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে। যার সর্বশেষ আপডেট পাওয়া যাবে: www.medical-info.dghs.gov.bd। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যমের সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থানে আহতদের তথ্য পাওয়া মাত্রই তা জেলা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে যাচাই করে এমআইএস সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয়েছে।

জাগো নিউজ: আহত জুলাইযোদ্ধাদের স্বাস্থ্যসেবায় কী কী উদ্যোগ নিয়েছিলেন?

নূরজাহান বেগম: মূল উদ্যোগ ছিল তাদের চিকিৎসা করা। আমরা সারাদেশে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করেছি। মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, রাশিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে ৭৮ জনকে পাঠিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করেছি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, নেপাল, চীন ও থাইল্যান্ড থেকে এ পর্যন্ত ২৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনেও চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এটি চলমান প্রক্রিয়া।

নির্দলীয়, সৎ ও দক্ষ লোক পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে

আহত রোগীদের উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সহায়তা করছে। অভ্যুত্থানে আহত জুলাইযোদ্ধাদের আজীবন সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির জন্য স্বাস্থ্যকার্ড প্রদান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গেজেটভুক্ত ১২ হাজার ৪২ জনের মধ্যে ৭ হাজার ৩৬৩ জনকে স্বাস্থ্যকার্ড বিতরণ করা হয়েছে।

জাগো নিউজ: আহতদের পুনর্বাসনের বিষয়টি বেশি সামনে আসছে, আপনাদের ভূমিকা কী?

নূরজাহান বেগম: জুলাইযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য ধামরাইয়ের কৃষ্ণনগরে একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম চলমান। যারা শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের সহায়ক উপকরণ সরবরাহ করা হবে।

আক্রান্তদের ওষুধজাত পণ্য, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও কাউন্সেলিং নিশ্চিত করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাইরে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও তাদের পুনর্বাসনে কাজ করছে।

এছাড়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত আহতদের উন্নত চিকিৎসা দিতে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে চীনের সহায়তায় রোবোটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে চালু হবে। এজন্য ২৭ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে; আরও ১৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

এখানে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন রোগীকে উচ্চমানের ফিজিওথেরাপি দেওয়া সম্ভব হবে। সেন্টারটিতে থাকবে ৬২টি উন্নত রোবোটিক থেরাপি ইউনিট, যার মধ্যে ২২টি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা চালিত। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন ঘটবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের পাশাপাশি সাধারণ রোগীরাও এ সেবা পাবেন।

জাগো নিউজ: লুটপাটের আখড়া এই স্বাস্থ্যখাত, কীভাবে ঢেলে সাজালেন?

নূরজাহান বেগম: আমরা আসার পরে পুরো স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজাতে হয়েছে। এখানেও আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা চেয়েছিলাম—নির্দলীয়, সৎ ও দক্ষ লোক। এরকম লোক পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। আমার সচিব জাহাঙ্গীর কিন্তু এখন জেলে। সচিব নিয়োগেই তো আমাকে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে।

চিকিৎসক পদায়নেও বহু ঝামেলা ছিল। কে স্বাচিপ, কে স্বাচিপ না—এগুলো তো আমি চিনি না। আমরা তো রাজনৈতিক লোক না। সবার রাজনৈতিক পরিচয় জানিও না। বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে দিয়েছি। প্রথমে দিয়েছি, পরে নানান অভিযোগ আসায় সরিয়ে দিয়েছি। এভাবে এক পর্যায়ে একটা কাঠামোতে এনেছি। এখনো কিছু জায়গা ঠিক হয়নি।

প্রথম দিকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) পদায়ন করেছি। দেশের আটটি বিভাগে বিভাগীয় পরিচালক এবং ৬৫টি জেলায় নতুন সিভিল সার্জন পদায়ন করেছি।

মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি) এবং বাংলাদেশ চিকিৎসা শিক্ষা অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল পুনর্গঠন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রো-ভিসি ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। নার্সিং কাউন্সিলে একজন রেজিস্ট্রার নিয়োগ করা হয়েছে। সরকারি ৩৭টি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ২৩ জন নতুন অধ্যক্ষ ও ১৭ জন উপাধ্যক্ষ পদায়ন করা হয়েছে।

১৫টি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এডিবির অর্থায়নে স্বাস্থ্যখাতে ডিজিটালাইজেশনের একটি প্রকল্প অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে শতভাগ না হলেও অধিকাংশ লুটপাট বন্ধ হয়ে যাবে।

জাগো নিউজ: চিকিৎসক, নার্স, এমটি বদলি-পদায়নে আর্থিক লেনদেনের খবর পাওয়া যায়, এটি বন্ধের উদ্যোগ নেবেন?

নূরজাহান বেগম: আমরা ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি। সব পদায়ন ও বদলি হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। অনলাইনে আবেদন করবে, একাধিক পছন্দ (চয়েস) দেবে। সে অনুযায়ী পদায়ন করা হবে। কারও কাছে ধরনা দিতে হবে না।

ইতোমধ্যে আমরা সাড়ে তিন হাজার নার্স পদায়নে এই ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। এটি সফল হলে চিকিৎসকসহ সবার জন্য এ ব্যবস্থা চালু করবো। আমরা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা ডিজিটালাইজ করবো। এতে অর্থ গ্রহণ (ঘুস) বন্ধ হয়ে যাবে।

জাগো নিউজ: চিকিৎসকদের পদোন্নতির দাবি দীর্ঘদিনের, এ নিয়ে আপনাদের চিন্তা কী?

নূরজাহান বেগম: শূন্যপদে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি দেবো। কাজ ইতোমধ্যে অনেকটাই হয়ে গেছে।

ইতোমধ্যে বিদ্যমান শূন্যপদে ২১৮ জন চিকিৎসককে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আরও প্রায় ৪০০ জন চিকিৎসককে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে।

সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) মাধ্যমে ৮৬টি বিষয়ে প্রায় ৮০০ চিকিৎসককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

গত ২৬ জুলাই সরকারি ছুটির দিনেও জুনিয়র কনসালটেন্ট পদে প্রায় দুই হাজার ৪০০ শূন্যপদে পদোন্নতির জন্য ডিপিসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। চলতি সপ্তাহে সিনিয়র কনসালটেন্ট পদেও ডিপিসি সভা আহ্বান করা হয়েছে।

সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ডিপিসি অনুষ্ঠিত হবে। এরপর প্রায় সাত হাজার চিকিৎসককে সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জাগো নিউজ: স্বাস্থ্যখাতে চিকিৎসকসহ জনবল সংকটের কথা সব সময় শোনা যায়, এ বিষয়ে কী উদ্যোগ নেবেন?

নূরজাহান বেগম: আমরা এরই মধ্যে শূন্যপদে তিন হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিচ্ছি। পরীক্ষা শেষ হয়েছে। শিগগির পদায়ন হবে।

৪৫তম, ৪৬তম ও ৪৭তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে আরও সাড়ে তিন হাজার চিকিৎসক নিয়োগ করা হবে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যাবে এবং চিকিৎসক সংকট অনেকাংশে লাঘব হবে।

নির্দলীয়, সৎ ও দক্ষ লোক পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে

শুধু চিকিৎসক নয়, ইতোমধ্যে পিএসসির মাধ্যমে তিন হাজার ৫১২ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু পদায়নের অপেক্ষায়।

এছাড়া আরও ৯০০ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন এবং পাঁচ হাজার সিনিয়র স্টাফ নার্স ও চার হাজার মিডওয়াইফের জন্য পদ সৃষ্টি সংক্রান্ত প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

জাগো নিউজ: সরকারি হাসপাতালে ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সেবা দেয়। এরপর রোগীরা কোথায় যাবে?

নূরজাহান বেগম: ইতোমধ্যে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটকে আগের জনবল দিয়েই দুই শিফটে চালাতে বলেছি। তারা সেটা করছে। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালেও দ্বিতীয় শিফটে কাজ চলছে। রাত ৮টা পর্যন্ত সেবা চালু রয়েছে।

এসব এখন পরীক্ষামূলক। দেখি, ধীরে ধীরে সব জায়গায় চালু করবো। তবে সব জায়গায় অরাজকতা। কয়টা জায়গা একসঙ্গে ধরবো? হুট করে তো সব ঠিক করতে পারবো না। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

জাগো নিউজ: কিডনি, বোনম্যারো ও লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট নিয়ে আইনি জটিলতা আছে। এগুলো নিরসনে উদ্যোগ নেবেন কি?

নূরজাহান বেগম: হ্যাঁ। ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন অধ্যাদেশ, ২০২৫’র খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। এটি শিগগির অধ্যাদেশে রূপ নেবে। ফলে কিডনি ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট সহজ হবে।

বাংলাদেশে অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম একাই এক হাজার ৮০০ ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেছেন, বাকিরা সবাই মিলে এর সমপরিমাণও করতে পারেননি। আমরা আরও কিছু চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পদায়ন করবো, যাতে দেশের মানুষ দেশেই কম খরচে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারে।

লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট নিয়েও কাজ চলছে। আশা করি, সেখানেও আমরা সফল হবো।

জাগো নিউজ: ওষুধ ও ভ্যাকসিনের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। সরকারি ইডিসিএলকে আরও শক্তিশালী বা সক্ষম করা যায় কি না?

নূরজাহান বেগম: হ্যাঁ, এ বিষয়েও আমাদের উদ্যোগ আছে। ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য গোপালগঞ্জে ইডিসিএলের একটি প্ল্যান্ট করা হয়েছিল। কিন্তু ভ্যাকসিনের নির্দিষ্ট একটি কার্যকারিতা থাকে। বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের অবস্থায়, যতই ফ্রিজিং গাড়িতে আনা হোক, অনেক সময় কার্যকারিতা কমে যায়।

এ কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি—প্ল্যান্টটি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে সরিয়ে আনা হবে। এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, তারা সহায়তা করবে। এটি বাস্তবায়িত হলে, ইডিসিএল দেশের হাসপাতালগুলোর ৮০ শতাংশ ওষুধ সরবরাহে সক্ষম হবে। বর্তমানে মাত্র ১৫ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করে।

এভাবে দেশের বড় অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় হবে।

জাগো নিউজ: দায়িত্ব পালনে কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কি?

নূরজাহান বেগম: সমস্যা হলো—সব জায়গায়, সব কাজেই গতি নেই। স্পিড কোথাও বাড়াতে পারছি না।

প্রত্যেকের মধ্যে একটা ‘জুজুর ভয়’ কাজ করে। ভবিষ্যতে কে আসবে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে হবে—এই মানসিকতা থেকে কাজের সাহস অনেক সময় হারিয়ে ফেলে। নির্ভীকভাবে কাজ করা এখন খুব কঠিন হয়ে গেছে।

জাগো নিউজ: স্বাস্থ্যখাত নিয়ে আপনার স্বপ্ন বা পরিকল্পনা কী?

নূরজাহান বেগম: দেশের মানুষের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাই আমার মূল লক্ষ্য। চিকিৎসা শিক্ষার মান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত করতে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। এটা না করলে, আমাদের চিকিৎসকরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা চাকরির সুযোগ পেতেন না।

প্রথম ধাপে বিদেশি প্রতিনিধিরা এসে পরিদর্শন করেন। অক্টোবর-নভেম্বরে আবার ফাইনাল ভিজিটে আসবেন। তখনই তারা অনুমোদন দেবেন কি না—সে সিদ্ধান্ত নেবেন। এটি ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

এছাড়া স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী একটি নতুন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের কাজ চলছে।

বর্তমানে চীনের অনুদানে রংপুরে এক হাজার শয্যার হাসপাতাল এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রামে ৫০০–৭০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণকাজ চলছে। এগুলো চালু হলে দেশের মানুষের চিকিৎসা সংক্রান্ত দুর্ভোগ অনেকটাই কমে যাবে।

নির্দলীয়, সৎ ও দক্ষ লোক পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে

জাগো নিউজ: নীরবে কাজ করেন। সকাল ৯টা থেকে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত অফিসে থাকেন। আপনার অধীনস্থরাও কেউ কেউ বিরক্ত। অথচ বাইরে প্রচার হয়—আপনি নাকি কাজই করেন না! এর কারণ কী?

নূরজাহান বেগম: কোথায় কাজ হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে না—এটা খুঁজে বের করা তো মিডিয়ার দায়িত্ব।

আমি কাজ করবো, আবার মিডিয়ার সামনে এসে বলবো—এই কাজ করেছি, ওই কাজ করছি—এ বিষয়টা আমার কাছে মোটেও শোভনীয় মনে হয় না।

 

 

আমার দায়িত্ব কাজ করা। আমি কাউকে দেখানোর জন্য কাজ করি না। কী কাজ করেছি, সেটা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে। আমি কেন মিডিয়ার কাছে যাবো? সাংবাদিকদের দায়িত্ব হচ্ছে, এগুলো খুঁজে বের করা।