
রাষ্ট্র সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দুই দফায় ৬৮টি অধিবেশন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এসব বৈঠকের মধ্যে ৮১টি ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে কমিশন। এর মধ্যে প্রথম দফায় ৪৫টি অধিবেশনে ৬২টি ও দ্বিতীয় দফায় ২৩টি অধিবেশনে ১৯টি মৌলিক ইস্যুতে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর নেতারা একমত হয়েছেন।
দুই দফা বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনায় মতপার্থক্য ও বিতর্কের পর গত ৩১ জুলাই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণী এই অধিবেশন সমাপনী টানেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ। তিনি জানান, বারবার আলোচনার পরও কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে এবং বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে ১০টি ইস্যুতে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) তারা পেয়েছেন; যা পরবর্তী সময়ে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হবে।
সনদের প্রাথমিক খসড়া চূড়ান্ত হলেও নোট অব ডিসেন্টসহ পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সনদ তৈরি, সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর সই আদায় এবং ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলোর কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। কারণ বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলো কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ছিল। তাদের মধ্যে কোনো দল মামলার হুমকি, কোনো দল রাজপথে নামার হুমকি আবার কোনো দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার ইঙ্গিত দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করাসহ এসব চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলার ওপর জুলাই সনদের সাফল্য নির্ভর করছে- এমনই মন্তব্য করেছেন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।
সনদে কী থাকবে এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে খবরের কাগজকে ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘সনদের মধ্যে থাকবে দুটি অংশ- একটি অংশে থাকবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো, অপর অংশে থাকবে দলগুলোর প্রতিশ্রুতির তালিকা। সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা নির্ধারণে প্রয়োজনে দলগুলোর সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসবে কমিশন। রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া এবং নোট অব ডিসেন্টসহ সব ইস্যু নিয়েই জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। খসড়া সনদে ঐকমত্য হওয়া উল্লিখিত প্রস্তাবগুলো নির্বাচনের পর দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।’
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদ তৈরির পটভূমি, ঐকমত্য কমিশনের গঠন ও কার্যক্রম তুলে ধরার পাশাপাশি ঐকমত্য হওয়া প্রস্তাব বা সুপারিশগুলো যুক্ত করা হবে। চূড়ান্ত খসড়ায় রাজনৈতিক দলের নেতা বা প্রতিনিধিদের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সই নেওয়া হবে। কমিশন আশা করছে, যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে, তা বাস্তবায়নে তারা নিজেরাই পথ তৈরি করবে। কমিশন এ ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। একই সঙ্গে মৌলিক এসব সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে খুব শিগগির কমিশনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানানো হবে।
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতেও দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলই দুই বছরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে। এদিকে জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি করেছে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। এ স্বীকৃতি ছাড়া জুলাই সনদে সই না করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। এমনকি স্বীকৃতি না দিলে সরকার ও কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকিও এসেছে জামায়াতের পক্ষ থেকে। আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করে অন্তর্বর্তী সরকারকে জুলাই সনদ কার্যকর করার দাবি এনসিপি নেতাদের।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘আশা করি জুলাই জাতীয় সনদ খুব তাড়াতাড়ি চূড়ান্ত হবে। এটি যখন বিএনপির কাছে আসবে, আমরা স্বাক্ষর করব। এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য আমরা জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আগামী দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য সব দলই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের যেসব সংশোধনী প্রয়োজন হবে, সেগুলো আমরা করব।’
সনদের আইনি ভিত্তি আদায়ে দলের কঠোর অবস্থান তুলে ধরে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি কী হবে, কখন ও কীভাবে বাস্তবায়ন হবে- এ বিষয়ে এখনো অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। যদি আইনির ভিত্তি না থাকে, তাহলে ঐকমত্য কমিশনে এত আলোচনার প্রয়োজন ছিল না। আমরা মনে করি, অধ্যাদেশ বা গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এই সনদের মাধ্যমেই আগামী সংসদ নির্বাচন হওয়া দরকার।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আগামী ৫ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করার সরকারি সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। পাশাপাশি আমাদের দাবি জুলাই সনদের সুরাহা হতে হবে। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী সেটা নিয়েও ঐকমত্য কমিশন কথা বলেনি। বাস্তবায়ন পদ্ধতির সুরাহা হলে সবাই স্বাক্ষর করবেন। আমরা বলেছি, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে। আর জুলাই সনদের ভিত্তিতেই হতে হবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন। আমরা নির্বাচিত সংসদের হাতে সংস্কারের কার্যক্রম ছেড়ে দেব না। জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংসদ গঠিত হবে বা গণপরিষদ গঠিত হবে। এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই এই সনদ কার্যকর করতে হবে। সরকার যেন ৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদের একটা সুরাহা করে। আর এক বছর পূর্তিতে সব পক্ষ একসঙ্গে পরিবর্তনের রূপরেখা উদযাপন করতে পারি।’
রাষ্ট্র সংস্কারের কমিশনের ১০ মাস
গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো প্রতিবেদন দেয়। পরে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এরপর ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে আইনবিধি সংস্কার করে বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন সম্ভব, এমন অনেক সুপারিশকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে। অন্যদিকে ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। এসব বিষয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে ৩৩টি দল তাদের মতামত দেয়।
প্রথম ধাপে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার এলডি হলে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। গত ৩১ জুলাই ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয় এসব অধিবেশনে দলগুলোর মধ্যে ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ২০টি মৌলিক ইস্যুতে কমিশনের অধিবেশন হয় ২৩টি। গত ২ জুন প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি মুহাম্মদ ইউনূস এ পর্বের আলোচনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ৩ জুন থেকে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা হয়। এতে মৌলিক সংস্কারের ১৯টিতে ঐকমত্য এবং ১০টি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ৩১ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের সমাপ্তি ঘটে।