
মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু আটকেপড়া বাংলাদেশি কর্মীদের ভাগ্য খুলতে যাচ্ছে। বোয়েসেলের মাধ্যমে আটকেপড়া সাড়ে ৭ হাজার বাংলাদেশি কর্মীদের দু’টি সেক্টরে নিয়োগ দিতে সম্মত হয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। মালয়েশিয়ায় কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ ওভারসিস এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য নতুন নিয়োগ অনুমোদন দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। ২০২৪ সালের ৩১ মে-এর মধ্যে একশ’ সিন্ডিকেট সদস্যের মাধ্যমে প্রায় ১৭ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত কর্মীদের এবার কনস্ট্রাকশন এবং ট্যুরিজম সেক্টরে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। এসব কর্মীদের মধ্যে অনেকেই সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে জমাকৃত টাকা ও পাসপোর্ট নিয়ে অন্য দেশে চলে গেছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কর্মী দেশটিতে যাওয়ার জন্য প্রহর গুনছেন। গতকাল কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছে। তবে এসব কর্মীদের বোয়েসেলের মাধ্যমে দেশটিতে যেতে কত অভিবাসন ব্যয় করতে হবে তা নির্ধারণ করা হয়নি।
দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। আটকেপড়া বাংলাদেশি কর্মীদের বোয়েসেলের মাধ্যমে দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়ায় বায়রার সাবেক শীর্ষ নেতা এ কে এম মোবারক উল্ল্যাহ শিমুল মালয়েশিয়া সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি উভয় দেশের সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী বোয়েসেলের পাশাপাশি বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে কর্মী প্রেরণের সুযোগ দেয়ার জন্য উভয় দেশের সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে সরকার কর্মী প্রেরণ প্রক্রিয়ায় নিয়মিত মনিটরিং করবে। এক প্রশ্নের জবাবে বায়রার সাবেক নেতা মোবারক উল্ল্যাহ শিমুল বলেন, মালয়েশিয়া সরকারের এ অনুমতির দরুন প্রায় সাড়ে ৭ হাজার আটকেপড়া বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ পাবে। তিনি আগামী ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে মালয়েশিয়ার অন্যান্য সেক্টরে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে কর্মী নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্মীদের আনয়নের লক্ষ্যে ডিমান্ড লেটার বা চাহিদাপত্র সত্যায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ জন্য ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম-এর (এফডব্লিউসিএমএস) অনলাইন পোর্টালে চেকলিস্ট অনুযায়ী নির্ধারিত সব তথ্যাদি দাখিল করতে হবে।
দাখিলকৃত ডকুমেন্টেসের মধ্যে রয়েছে, কোম্পানির পক্ষ থেকে অনুমোদনপত্র, যা ম্যানেজার পর্যায়ের বা তদূর্ধ্ব কোনো কর্মকর্তার হতে হবে; বাংলাদেশ হাইকমিশনে জমাকৃত সত্যায়ন ফি-এর মূল ব্যাংক সিøপ; ৪-৫ জন কর্মীর সর্বশেষ বেতন সিøপ; এবং কোম্পানির প্রোফাইল, যার মধ্যে কোম্পানির প্রোফাইল, বর্তমান কর্মীর সংখ্যা (স্থানীয় ও বিদেশি), প্রয়োজনে ২/৩ জন বাংলাদেশি কর্মীর মোবাইল নম্বর এবং বিগত তিন মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট থাকতে হবে এবং ব্যাংক ব্যালান্সও যথাযথ হতে হবে যেমন ১০০ জন কর্মীর জন্য ন্যূনতম দুই লাখ মালয়েশিয়ান রিংগিত ব্যালান্স থাকা প্রয়োজন।
এছাড়া, ফরেন ওয়ার্কার্স কম্পেনসেশন স্কিম (সকসো) এবং ফরেন ওয়ার্কার্স হাসপাতালাইজেশন ও সার্জিকাল স্কিমের নমুনা দলিল, কর্মীদের আবাসন সংক্রান্ত জেটিকে সার্টিফিকেট, নির্মাণ চুক্তিপত্র, অঙ্গীকারনামা বা গ্যারান্টি লেটার, ডিরেক্টরের স্বাক্ষরিত ডিমান্ড লেটার, পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি, নিয়োগপত্র, বোয়েসেল ও নিয়োগকারীর মধ্যে চুক্তিপত্র এবং মালয়েশিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত কোটার অনুমোদনপত্রও দাখিল করতে হবে। পাশাপাশি, অনলাইনে দাখিলকৃত তথ্যাদির মূল কপি এবং এক সেট ফটোকপি বাংলাদেশ হাইকমিশনে জমা দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ হাইকমিশন।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় প্রায় ৫ লাখ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও নানা অনিয়ম ও কোটা বাণিজ্যের অভিযোগে তা মাঝপথেই স্থগিত হয়ে যায়। গত বছর পর্যন্ত একশত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ৪ লাখ ৭৫ হাজার বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে কর্মসংস্থান লাভ করেছে। এদিকে, দীর্ঘ অনিশ্চয়তা ও প্রশাসনিক জটিলতার পর মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য শর্তসাপেক্ষে পুনরায় উন্মুক্ত হওয়ার আভাস মিলেছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দুই দেশের মধ্যে নতুন সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী নির্ধারিত কোটা, খরচ নিয়ন্ত্রণ ও নিয়োগ পদ্ধতি স্বচ্ছ রাখার শর্তে কর্মী পাঠানো আবারো শুরু হতে পারে।
সূত্র জানায়, মালয়েশিয়া সরকার ‘সিলেক্টভি রিক্রুটমেন্ট’ মডেল চালু করতে চায়, যেখানে কেবল নিবন্ধিত এবং সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত এজেন্সির মাধ্যমেই কর্মী পাঠানো যাবে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি খসড়া কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়, যাতে বাংলাদেশ সরকার কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করেছে। বায়রা (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস)-এর সাবেক ইসি সদস্য মোহাম্মদ আলী জানান, আমরা চাই মালয়েশিয়ায় একটি স্বচ্ছ ও বৈধ প্রক্রিয়ায় অভিবাসন হোক, যেখানে কোনো সিন্ডিকেট ও দালাল চক্রের কোনো সুযোগ থাকবে না। তিনি আরো বলেন, কর্মী প্রতি সর্বোচ্চ খরচ নির্ধারণ, মেডিক্যাল ও ভিসা প্রসেসিং সময় নির্ধারণ করতে হবে। মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করতে হবে। ইতোপূর্বে মালয়েশিয়াগামী কর্মী প্রতি ৪ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় কাজ করতে ইচ্ছুক তার শ্রমিকদের শোষণের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে। ২ সপ্তাহ আগে বাংলাদেশি সরকার এবং মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে কুয়ালালামপুরে একটি বৈঠকের সময় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানান, আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এদিকে, অনেকে ইতোমধ্যেই চুক্তিভিত্তিক খরচ পরিশোধ করে রেখেছেন। শর্তসাপেক্ষে বাজার খোলার খবরে তারা আশার আলো দেখছেন। একাধিক রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক বলছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ধরে রাখতে হলে শুধু চুক্তি নয়, বাস্তবায়ন পর্যায়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে, গতকাল কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন এক সতর্ককরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশে কর্মী নেয়ার লক্ষ্যে বর্তমানে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক নেই। সাবাহ প্রদেশের কর্তৃপক্ষ থেকে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশে কর্মী প্রেরণের কথা বলে মালয়েশিয়ায় গমনেচ্ছু বাংলাদেশিদের কাছ থেকে পাসপোর্ট এবং নগদ টাকা সংগ্রহ করছে বলে বাংলাদেশ হাইকমিশনের গোচরীভূত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশে কর্মী নেয়ার লক্ষ্যে বর্তমানে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কোনো চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক নেই। কোনো দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশি কর্মীরা যাতে প্রতারণার শিকার না হয় তার জন্যই এই সতর্ককরণী নোটিশ জারি করা হয়েছে।