Image description

জুলাই–আগস্ট ২০২৪। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন এক বাঁক রচনা করে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান। তৎকালীন উত্তাল রাজপথে দৃপ্ত পদক্ষেপে ছিল হাজারো তরুণ-তরুণী। মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে ফেনীর ছাত্রীরা যেমন রুখে দাঁড়িয়েছিল অযৌক্তিক কোটা ও রাষ্ট্রীয় দমন–পীড়নের বিরুদ্ধে, ঠিক তেমনভাবেই আজ তারা আড়ালে সরে যাওয়ায় উঠেছে প্রশ্ন—কোথায় গেল সেই সাহসী মেয়েরা?

সে সময়ের চেনা মুখদের এখন আর দেখা যায় না আন্দোলনের ব্যানারে। কেউবা নিঃশব্দে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, কেউ বা পারিবারিক বা সামাজিক বাধায় হয়েছে নিস্পৃহ। ‘কোটা পূর্ণবহাল চলবে না’ স্লোগানে রাজপথ কাঁপানো সেই তরুণীদের অনুপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাঙ্গনের সচেতন মানুষ।

ফেনী সরকারি জিয়া মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সুরাইয়া ইয়াছমিন সেই সময়ের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, ‘৭ জুলাই আমি ‘কোটা পূর্ণবহাল চলবে না ’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হই। তখন দেশের অবস্থা দেখে ঘরে বসে থাকতে পারিনি। ওই গ্রুপে জানানো হয় যারা আন্দোলনে অংশ নিতে চায়, তারা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত হতে। আমিই ছিলাম ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের প্রথম নারী সদস্য। ধীরে ধীরে অনেক মেয়েরা যুক্ত হন। পরে কেন্দ্র থেকে সমন্বয়ক হওয়ার জন্য নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর দিতে বলা হয়। তখন জাফর ও তাজিম ভাইয়ের কথামতো আমি রাজি হয়েছিলাম। পরে কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষিত ১৮ জন সমন্বয়কের তালিকায় ফেনী জেলা নারী সমন্বয়ক হিসেবে আমার নাম ছয় নম্বরে আসে। দায়িত্ব পাওয়ার পর প্ল্যাকার্ড তৈরি থেকে শুরু করে আন্দোলনের বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কাজে যুক্ত ছিলাম।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া তার জন্য সহজ ছিল না বলেও জানান তিনি। চারপাশে শাসক দলের লোকজন, পারিবারিক বাধা সব উপেক্ষা করেই মাঠে নেমেছিলেন তিনি। তবে জুলাইয়ের পর মেয়েদের আর দেখা যায়নি বলেও জানান সুরাইয়া। পরিবার থেকে এখন বলা হয় ‘তুমি মেয়ে মানুষ, ঘরে থাকো। এসব আন্দোলনে তোমাদের আর দরকার নেই,’—বলেন সুরাইয়া।

চট্টগ্রাম বিএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী আদিবা ইবনাত রিদিকাও আন্দোলনের সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রথমবার ফেনীতে মাঠে নামার দিনটি ছিল ১৫ জুলাই। নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে আলোচনা শুরু করি। সেখান থেকে সংগঠিত হয়ে একটি দল গঠনের মাধ্যমে ১৫ জুলাই প্রথমবারের মতো ফেনীতে মাঠে নেমেছিলাম। কিছু ছাত্রীর সঙ্গে অভিভাবকরাও সঙ্গে ছিল। পরে আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী আমাদের ওপর হামলা চালায়, গায়ে হাত তোলে, বেঁধে মারধর করে। আন্দোলন চলাকালীন বক্তব্য ও স্লোগান দিয়েছিলাম। মেয়েরা ছিলাম সামনে, ভাইয়েরা ছিল পেছনে। সবসময় সংগ্রাম ছিল দেশের জন্য। লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচার ও দুর্নীতিমুক্ত একটি বাংলাদেশ। তবে এখনো কাঙ্খিত পরিবর্তন আসেনি। স্বৈরাচারের দোসররা এখনো সমাজে বিচরণ করছে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের ক্ষমতা নিয়ে ব্যস্ত। ফলে নারীরা উপেক্ষিত ও পিছিয়ে পড়েছেন। আন্দোলনের পরেও নারীরা নানাভাবে হুমকির মুখে পড়ছেন।

আরেক আন্দোলনকারী, ফেনী কম্পিউটার ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী তাসফিয়া তাসনিম স্মরণ করিয়ে দেন ১৭ জুলাইয়ের ট্রাংক রোডের ভয়াবহ হামলার কথা। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আন্দোলনের সময়ে নারীরা প্রথম সারির প্রতিরোধের ঢাল হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ১৭ জুলাই ট্রাংক রোডে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অতর্কিত হামলার পর অনেক মেয়ে আর মাঠে ফিরতে পারেনি, কিন্তু আমরা ছিলাম ভাইদের রক্ষক হয়ে। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাকে নিয়মিত খোঁজ করতো। নিজের নিরাপত্তার জন্য বাড়ি ফেরার পথও পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখন নিজের শিক্ষাজীবনকে গুছিয়ে নিতে আগের ছন্দে ফিরি যেতে চাই। কখনো কোনো রাজনৈতিক দলে ছিলাম না, আগামীতেও যাবো না। আমার অংশগ্রহণ ছিল কেবল একজন সচেতন নাগরিক ও শিক্ষার্থী হিসেবে অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জায়গা থেকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নারী আন্দোলনকারী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দেশের স্বার্থে আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম। ৫ আগস্ট পরবর্তী এ প্ল্যাটফর্মের কতিপয় কিছু লোকের বির্তকিত কর্মকাণ্ডের কারণে আমরা সরে দাঁড়িয়েছি। আমাদের চাওয়া ছিল দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হোক, সেটি হয়েছিল। আগামীতে যদি এমন কোন স্বৈরাচার তৈরি হয় আমরা আবারো মাঠে নামবো। 

ফেনীতে নারীদের এই সাহসী ভূমিকা এবং পরবর্তীতে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে কথা বলেন জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সংগঠক আবদুল্লাহ আল জুবায়ের। তিনি বলেন, ‘নারীরা আন্দোলনে শুধু অংশ নেয়নি, অনেক সময় ভাইদের রক্ষাকারী হয়ে সামনে থেকেছে। আন্দোলন সফল হওয়ার পর তারা পড়াশোনায় ফিরেছে। অনেকেই ব্যক্তিগত কারণে বা পরিবারের চাপে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।’

নারী সদস্যদের সরে যাওয়ার পেছনে সংগঠনের কিছু সদস্যের বিতর্কিত আচরণ দায়ী কি না, জানতে চাইলে জুবায়ের বলেন, ‘আমাদের কাছে এমন কোনো অভিযোগ আসেনি। যারা সরে গেছে, তারা পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কারণে গেছে।’

জেলা আন্দোলনের আরেক তৎকালীন সংগঠক ওমর ফারুক বলেন, ‘আমাদের বোনেরা আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে পাশে ছিল। কেউ কেউ তখন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। এখন তারা বিভিন্ন শহরে পড়াশোনা করছে, তাই ফেনীর মাঠে তাদের দেখা যাচ্ছে না।’

২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র অভ্যুত্থানের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল দেশের নারীরা। ফেনী জেলায় তারা হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের প্রতীক। অথচ কয়েক মাসের ব্যবধানে রাজপথ থেকে তাদের সরে যাওয়া এখন কেবল প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে না, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নারীদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবনারও খোরাক জোগাচ্ছে। সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই দেবে আবার কোনো অন্যায়ের মুখোমুখি হলে এই নারীরা কি ফের রাজপথে ফিরবেন?