
গত বছর লাখো মানুষ রাজপথে নেমে কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের পর গঠিত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানবাধিকার রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এমন মন্তব্য করেছে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তারা এ নিয়ে এক প্রতিবেদনে আরও বলেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুন সহ যে ভয় ও দমন-পীড়নের পরিবেশ ছিল, তার অনেকটাই বন্ধ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে, নতুন সরকার এখনো নির্বিচারে গ্রেপ্তার করে রাজনৈতিক বিরোধীদের টার্গেট করছে এবং মানবাধিকার রক্ষায় কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এশিয়া বিভাগের উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন- যে হাজারো মানুষ এক বছর আগে শেখ হাসিনার দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নেমেছিল, তাদের অধিকারভিত্তিক গণতন্ত্রের স্বপ্ন এখনো অপূর্ণ। নতুন সরকার যেন একটা অপরিবর্তিত নিরাপত্তা খাত, সহিংস ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং প্রতিশোধপরায়ণ রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে আটকে গেছে।
২০২৪ সালে গঠিত ১১টি সংস্কার কমিশন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং দেশি-বিদেশি অধিকারকর্মীরা সরকারের কাছে সুস্পষ্ট সুপারিশ পেশ করলেও সেগুলো এখনো ঝুলে আছে। অন্যদিকে, সরকার ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিরাষ্ট্রীয় গ্রুপগুলো- যার মধ্যে নারী অধিকার এবং সমকামীদের অধিকারের প্রতি শত্রুতামূলক ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা আছে, তারা মব সহিংসতা এবং সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়ন চলছে। রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের কমপক্ষে ১৪টি বাড়িতে ভাঙচুর করা হযেছে ২৬ ও ২৭শে জুলাই। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালান। এর আগে পাঁচ সপ্তাহের বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১৪০০ জন নিহত হন বলে জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৮ই আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। তবে, এখনো বন্দি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে- যা নিরাপত্তা খাত সংস্কারের জরুরি প্রয়োজনকে নির্দেশ করে।
১৬ই জুলাই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির মিছিল ঘিরে নিরাপত্তা বাহিনী ও নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন। এরপর, পুলিশ শত শত সন্দেহভাজন আওয়ামী লীগ সমর্থককে নির্বিচারে আটক করে এবং ৮৪০০ জনের (অধিকাংশই অজ্ঞাতনামা) বিরুদ্ধে ১০টি হত্যা মামলা দায়ের করে। তবে, সরকার ‘গণগ্রেফতারের’ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত, পুলিশ ৯২,৪৮৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে, যার অধিকাংশই হত্যাকাণ্ড-সংশ্লিষ্ট। সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ প্রায় ১১৭০টি মামলায় ৪০০’র বেশি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর নাম আছে, যাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। মানবাধিকার সংস্থার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম অক্টোবর ২০২৪ থেকে অন্তত ৬৮টি হত্যা বা হত্যাচেষ্টার মামলায় আটক আছেন। যার মধ্যে ৩৬টি ঘটনার সময় তিনি দেশে ছিলেন না। অধিকাংশ মামলাতেই কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন হয়নি। হাই প্রোফাইল রাজনৈতিক মামলার আসামিরাও তাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং চিকিৎসা ও জামিন না দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।
৩রা আগস্ট শেখ হাসিনাসহ তিনজন আসামির বিরুদ্ধে প্রথম মামলার বিচার শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে অধিকাংশ মামলারই বিচার প্রক্রিয়া এখনো অচল এবং অনেক বন্দির বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণই উপস্থাপন করা হয়নি। শত শত মানুষকে হয়তো বিতর্কিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে আটক করা হয়েছে, যা আগের সরকার বিরোধী মত দমন করতে ব্যবহার করত। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালানো ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এ ৮,৬০০’র বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগপন্থী বলে দাবি। যদিও গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি, তবে অনেক গ্রেপ্তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং নির্বিচার বলেই মনে হচ্ছে। একই সময়ে, হাসিনা সরকারের আমলে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওতায় আনায় সরকার অনেকটাই ব্যর্থ। বাংলাদেশ পুলিশের এক মুখপাত্র জুলাইয়ে বিবিসিকে বলেন, গত বছর জুলাই-আগস্টের সহিংস অভিযানে জড়িত মাত্র ৬০ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যেখানে বহু পুলিশ ও সেনা ইউনিট, এমনকি কুখ্যাত র্যাবও অংশ নেয়।
২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট, হাসিনা আমলে সংঘটিত গুমের ঘটনা তদন্তে সরকার কমিশন গঠন করে। ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ সনদ স্বাক্ষর করে। কমিশনে এখন পর্যন্ত ১,৮০০’র বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে এবং তারা দুটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তৃতীয়টি ডিসেম্বরের জন্য নির্ধারিত। কমিশনাররা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানান, তারা উল্লেখযোগ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন, তবে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রমাণ নষ্ট করেছে, সহযোগিতা করছে না, এবং দোষীদের জবাবদিহির চেষ্টায় বাধা দিচ্ছে। অভিযুক্ত অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দেশ ত্যাগে সক্ষম হন। ইউনূস সরকার ১১টি কমিশন গঠন করেছে, যেগুলো পুলিশ, বিচারব্যবস্থা ও নারী অধিকারসহ বিভিন্ন খাতে সাংবিধানিক সংস্কারের সুপারিশ করেছে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত সংস্কার এজেন্ডায় রাজনৈতিক ঐক্যমতের উদ্যোগও খুব ধীরগতিতে চলছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- নারীদের পূর্ণ, সমান, কার্যকর ও নিরাপদ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৩২৫ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী, বিশেষ করে পুনর্গঠিত নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে।
মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে অবশ্যই নির্বিচার গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে, বিশেষত প্রি-ট্রায়াল আটক যেন ব্যতিক্রম হয়, নিয়ম নয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওতায় এনে দণ্ডমুক্তি সংস্কৃতি ভাঙতে হবে, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত করতে হবে, র্যাব বিলুপ্তসহ নিরাপত্তা খাত সংস্কার করতে হবে এবং নারী অধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, বিদেশি সরকার ও জাতিসংঘের উচিত এই সরকারকে সমর্থন দেওয়া- যার মধ্যে থাকা উচিত দোষীদের বিরুদ্ধে লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং যারা বাংলাদেশ থেকে পালিয়েছে, তাদের বিচার করা, এমনকি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সর্বজনীন বিচারাধিকার প্রয়োগ করেও। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ যেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ইউনূসের সরকার যে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা স্পষ্ট। কিন্তু মানবাধিকার পরিস্থিতিতে বাস্তব ও স্থায়ী পরিবর্তন আনতে এখনই পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যে রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে নিপীড়নের শিকার ছিল, তাদেরই এখন এগিয়ে এসে নিশ্চিত করতে হবে- এমন ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে এবং সকলের অধিকার রক্ষা নিশ্চিত হয়।