Image description

পানির অপর নাম জীবন— চিরন্তন এ সত্যকে যেন উপহাস করা হচ্ছে সবার চোখের সামনে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ওয়াসার ‘শান্তি’ মিনারেল ওয়াটার প্রস্তুতে অভিনব এক প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর— বলছেন বিশ্লেষকেরা।

জানা যায়, বিশুদ্ধতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে ওয়াসার ‘শান্তি’ মিনারেল ওয়াটার। অথচ সেখানে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ’ সোডিয়াম বাইকার্বনেট দিয়ে পানি ‘বিশুদ্ধিকরণ’ করা হচ্ছে। এটি আবার সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে শুরু করে ম্যারাথন দৌড়েও ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘মেয়াদোত্তীর্ণ’ সোডিয়াম বাইকার্বনেট দিয়ে ‘কথিত’ বিশুদ্ধ পানি শরীরের হার্ট (হৃৎপিণ্ড) থেকে শুরু করে লাং (ফুসফুস), ব্লাড (রক্ত); যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে জটিল সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিরপুরের ওয়াসার ‘শান্তি’ বোতলজাত প্ল্যান্টে পানি বিশুদ্ধকরণের অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় সোডিয়াম বাইকার্বনেট। প্রতি ৬০ হাজার লিটার পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম সোডিয়াম বাইকার্বনেট ব্যবহার করা হয়। প্ল্যান্টে ব্যবহৃত বিশুদ্ধকরণের এই রাসায়নিক পদার্থের মেয়াদ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে শেষ হয়েছে। গত পাঁচ মাসে মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও এখন পর্যন্ত সেই কেমিক্যাল দিয়েই চলছে পানি উৎপাদন।

মিরপুরের ওয়াসার ‘শান্তি’ বোতলজাত প্ল্যান্টে পানি বিশুদ্ধকরণের অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় সোডিয়াম বাইকার্বনেট। প্রতি ৬০ হাজার লিটার পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম সোডিয়াম বাইকার্বনেট ব্যবহার করা হয়। প্ল্যান্টে ব্যবহৃত বিশুদ্ধকরণের এই রাসায়নিক পদার্থের মেয়াদ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে শেষ হয়েছে। গত পাঁচ মাসে মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও এখন পর্যন্ত সেই কেমিক্যাল দিয়েই চলছে পানি উৎপাদ

প্ল্যান্টে রক্ষিত মেয়াদোত্তীর্ণ বস্তার ব্যাচ নং- ২০২৩০২১০। ২৫.১ কেজি ওজনের বস্তা। চীনের কোম্পানি মালানের (Malan) বস্তার ওপরে লেখা আছে- সোডিয়াম বাইকার্বনেট ৯৯ %। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব উপাদান ব্যবহার ও বস্তা মজুত রাখার প্রমাণ ঢাকা পোস্টের কাছে রয়েছে।

বেঙ্গালুরুতে খাবার পানি গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করলেই জরিমানা

বর্তমানে বাজারে ওয়াসার ২৫০ মিলিলিটার, ৫০০ মিলিলিটার, এক লিটার, দেড় লিটার, দুই লিটার, পাঁচ লিটার ও ২০ লিটারের (শুধুমাত্র জার ফিলিং) বোতল রয়েছে।

ঢাকা ওয়াসার দাবি, শান্তি পানি বিশুদ্ধ করতে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান সেভেন ট্রেন্ট সার্ভিস জিআই ওয়াটার ট্রিটমেন্ট সিস্টেম ব্যবহৃত হয়। এটি ১১টি ধাপে কাজ করে। অর্থাৎ আল্ট্রাভায়োলেট ইউনিট, মাল্টিমিডিয়া ফিল্টারেশন, অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ফিল্টারেশন, টু-ইন সফটনার, রিভার্স অসমোসিস ট্রিটমেন্ট, মিনারেল ডোজিং, মাইক্রোফিল্ট্রেশন ও ওজোন ট্রিটমেন্ট ধাপ অতিক্রম করে অবশেষে তৈরি হয় বিশুদ্ধ পানি। পরে পরীক্ষাগারে এটির মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

পাঁচ মাসে ২৬ লাখ লিটার পানি উৎপাদন

ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যাল দিয়ে বিশুদ্ধ করে বাজারে ১৩ লাখ ৩২ হাজার পাঁচ লিটার পানি সরবরাহ করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় ২৬ লাখ লিটার পানি উৎপাদন করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার মধ্যে ওয়াসার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বোতলজাত বিশুদ্ধ পানির ব্র্যান্ড ‘শান্তি’ পানির ২০টি পরিবেশক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওয়াসার মূল ভবন ও পানি উৎপাদনের প্ল্যান্টে নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তির বোতলজাত পানি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সর্বসাধারণের কাছে বিক্রি করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশকেরা সরবরাহ করেন এই পানি। বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি), ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি) এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সচিবের দপ্তরে শান্তি পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

বিল-লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে ঢাকা ওয়াসার কমিটি গঠন

২০টি পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সারা ঢাকা শহরে এই পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- আমিন বাজার ও মিরপুর এলাকায় মেসার্স সাদ ট্রেডিং এজেন্সি, শেরে বাংলা নগর এলাকায় মেসার্স জাহাঙ্গীর এন্টারপ্রাইজ, তেজগাঁও এলাকায় মেসার্স সাজী এন্টারপ্রাইজ, ধানমন্ডি এলাকায় মেসার্স সায়েম এন্টারপ্রাইজ, রূপনগর এলাকায় মেসার্স দি সিটি এন্টারপ্রাইজ, খিলগাঁও এলাকায় মেসার্স আবজাদ ইন্টারকন, মতিঝিল এলাকায় মেসার্স এন এস ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, উত্তরা এলাকায় মেসার্স অসি এন্টারপ্রাইজ, বাড্ডা এলাকায় মেসার্স ভার্জিন এন্টারপ্রাইজ, রমনা এলাকায় মেসার্স অ্যাডভান্স টেকনিক্যাল পার্টস, কাফরুল এলাকায় মেসার্স আবরার ট্রেডার্স, মিরপুর এলাকায় মেসার্স রাকিব এন্টারপ্রাইজ, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় মেসার্স আল্লাহর দান এন্টারপ্রাইজ, দারুস সালাম এলাকায় মেসার্স শেখ নোহান এন্টারপ্রাইজ, মিরপুরে মেসার্স আনোয়ার এইচ এন্টারপ্রাউজ, তেজগাঁও এলাকায় মেসার্স এম এস ট্রেডার্স ও মেসার্স জান্নাত কনস্ট্রাকশন, মিরপুর-২ এলাকায় মেসার্স মিন্টু এন্টারপ্রাইজ, মিরপুর-১০ এলাকায় মেসার্স নগর সেবা ও শ্যামলী এলাকায় মেসার্স লাম ইন্টারন্যাশনাল।

মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যালে জীবাণু মরে না, সমস্যা দেখা দিতে পারে রক্তে

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোডিয়াম বাইকার্বনেট শরীরের সঙ্গে যতটুকু খাপ খায় সেই হিসেবে তৈরি করা হয়। যদি এটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়, তাহলে সোডিয়াম বাইকার্বনেট ওই অবস্থায় থাকে না। তার কম্পোজিশন চেঞ্জ (গঠন পরিবর্তন) হয়ে যায়।

‘কম্পোজিশন চেঞ্জ হয়ে গেলে তো এটি শরীরের সঙ্গে খাপ খাবে না। শরীরে সমস্যা হবেই। হয় সোডিয়াম বেশি হয়ে যাবে, না হয় কার্বনেট বেশি হয়ে যাবে। এখানে শরীরের যেকোনো সিস্টেমে সমস্যা হতে পারে। শরীরের যেসব সিস্টেম আছে, হার্ট থেকে শুরু করে লাং, ব্লাড; যেকোনো জায়গাতে আপনার এটি সমস্যা তৈরি করতে পারে। শরীরে একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।’

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম লুৎফর রহমান বলেন, খাবারের পানি বিশুদ্ধ করার জন্য সোডিয়াম বাইকার্বনেটের তেমন ব্যবহার নেই। এক্ষেত্রে আমরা অ্যালাম বা ফিটকিরি ব্যবহার করে থাকি। এটি ব্যবহার করলে পানিতে থাকা জীবাণু মারা যায় এবং পানিতে থাকা ময়লা তলানিতে জমা হয়। আর যদি পানির পিএইচ মান কম থাকে, মানে পানির অ্যাসিডিটির পরিমাণ বেড়ে যায় তাহলে সেটি নিউট্রাল করতে সোডিয়াম বাইকার্বনেট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মূলত পানির বিশুদ্ধকরণে এটির ব্যবহার নেই। সোডিয়াম বাইকার্বনেট ব্যবহার হয় খাবার সোডা ও কাপড় কাচা সোডার ক্ষেত্রে।

পণ্য খালাসে বিলম্ব এড়াতে শর্তসাপেক্ষে ছাড়পত্র দেবে বিএসটিআই

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যে প্রবলেমের কারণে সোডিয়াম বাইকার্বনেট ব্যবহার করা হয়, সেটি যদি মেয়াদোত্তীর্ণ হয় তাহলে নতুন প্রবলেম তৈরি করবে। যেমন- আপনি বাসি ও পচা খাবার খান, সেই খাবারে আপনার সমস্যা হয় না? পেটে গন্ডগোল থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় সমস্যা হতে পারে। খাবারটা যখন রান্না করা হয় সেটি আপনার শরীরের উপযোগী করে করা হয়। যখন খাবারটি বাসি-পচা হয়ে যাবে বা খুব বেশি হিটে রান্না করা হবে, তখন এটির রাসায়নিক গঠন পরিবর্তন হয়ে যাবে। শরীরের হজম প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটাবে। অর্থাৎ মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি পানি বিশুদ্ধ হবে না। আর বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি পান না করলে পেটের পীড়া থেকে শুরু করে নানা সমস্যা হতে পারে।

অনুমোদন দিয়ে খোঁজ নেয়নি বিএসটিআই

শান্তি পানির বিশুদ্ধকরণের প্রতিটি ধাপ দেখে এটিকে মানসম্পন্ন হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছিল বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। বোতলে বিএসটিআই-এর মনোগ্রামও ব্যবহার করে শান্তি। তবে, নিয়মিত তদারকির অভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যালের বিষয়টি তাদের চোখ এড়িয়ে গেছে।

এ বিষয়ে বিএসটিআই-এর সার্টিফিকেশন মার্কস উইংয়ের পরিচালক (সিএম) মো. সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্ট বলেন, “ওয়াসার পরিচালিত ‘শান্তি’ বোতলজাত প্ল্যান্টের উৎপাদিত পানি বিএসটিআই অনুমোদিত। আমরা আপনার অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে দেখব। তারপর ব্যবস্থা নেব।”

প্রমাণ থাকার পরও অস্বীকার করছে ওয়াসা

মেয়াদোত্তীর্ণ সোডিয়াম বাইকার্বনেট ব্যবহার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ‘শান্তি’ বোতলজাত পানি উৎপাদন প্ল্যান্টের ম্যানেজার মো. আজিমুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখন আমরা চালাচ্ছি না। আপনি বরং তার (কেমিস্ট অফিসার) সঙ্গে কথা বলেন। আমি অসুস্থ, হাসপাতালে আছি। এটা সঠিক নিউজ না। আমাদের এটা নাই। দ্রুত... ইয়ে করছি।’

মিরপুরের‍ ‘শান্তি’ বোতলজাত পানি উৎপাদন প্ল্যান্টের কেমিস্ট অফিসার জ ও বাবর বলেন, ‘আপনি কাল প্ল্যান্টে আসেন। আপনাকে প্রাক্টিক্যালি সব দেখাব। মেয়াদ কখনও উত্তীর্ণ হয় না। মানে, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়ও না। এটার পরে আমাদের আরও তিনটা ফিল্টারেশন (পরিশোধন) হয়।’

‘আমাদের কথা বলার নিয়ম নেই। আপনি আসেন। আপনার সঙ্গে কথা বলার রাইট আমার নাই’— বলেন ওই কর্মকর্তা।

তবে, জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যালের বস্তা মজুতের বিষয়টি নিজ চোখে দেখেন। এ সংক্রান্ত তথ্যচিত্র ও ভিডিও সংরক্ষিত রয়েছে।

সোডিয়াম বাইকার্বনেট মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ব্যবহারে সমস্যা হয় কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে জ ও বাবর বলেন, ‘সমস্যা হয় না। মেয়াদোত্তীর্ণও হয়নি। এটা হলো সোডিয়াম বাইকার্বনেট থেকে যখন একটু... এগুলো হলো সল্ট, বুঝতে পারছেন? এটা কী হবে- সোডিয়াম বাইকার্বনেট থেকে এর পটেন্সি (কার্যকারিতা) কমে যাবে। অর্থাৎ সোডিয়াম বাইকার্বনেট থেকে আস্তে আস্তে..., মানে হাইড্রোজেন কমে কার্বনেট হয়ে যায়। ওই কার্বনেট ইউজ (ব্যবহার) করা যায়।’

মেয়াদোত্তীর্ণ সোডিয়াম বাইকার্বনেট ব্যবহার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ওঅ্যান্ডএম) প্রকৌশলী এ কে এম সহিদ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি বিষয়টি দেখতেছি। আমি এখনই ওদের সাথে ইয়ে... করতেছি।’

এ বিষয়ে জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান মিয়াকে একাধিকবার কল দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। মেসেজ দিলেও তিনি তার উত্তর দেননি।