Image description

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক আন্দোলনে রাজপথে নেমেছিল ছাত্র-জনতা। এই আন্দোলনের একজন ছিলেন নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার তরুণ মামুন মিয়া। তিনি পেশায় একজন গার্মেন্টসকর্মী। গণ-অভ্যুত্থানে তার সঙ্গে ছিলেন সমবয়সি একই জেলার কেন্দুয়া উপজেলার তোফাজ্জল হোসেন।

 
তিনিও রাজমিস্ত্রী। কর্মসূত্রে দুজনই ছিলেন ময়মনসিংহের ভালুকায়। আন্দোলনের সময়ে সেখানে তাদের পরিচয়, সেখান থেকেই গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব।

দিনটি ছিল ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, উত্তাল আন্দোলনের সেই দিনে ময়মনসিংহ মহাসড়কের মাস্টারবাড়ি এলাকায় আওয়ামী লীগ বাহিনীর হামলায় নির্মমভাবে নিহত হন তোফাজ্জল।

সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এই মামুন। তিনিই ভিডিও ধারণ করেছিলেন সেই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলে যাওয়া ব্যক্তিদের- যা হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।

 

কিন্তু এই সাহসিকতার ফল ছিল ভয়াবহ। মামুনের ভিডিওটি ছিল হত্যাকারীদের সনাক্ত করার একমাত্র প্রমাণ।

 
মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর তাকে টার্গেট করা হয়। এরই জের ধরে ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে মামুনকে অপহরণ করা হয়। দুদিন ধরে চলে অমানবিক নির্যাতন, পায়ের নখ উপড়ে ফেলা হয়, শরীরজুড়ে চলে নির্মম শারীরিক নির্যাতন। ১২ ফেব্রুয়ারি তাকে ফেলে যাওয়া হয় সিলেট মহাসড়কের পাশে। পরে উদ্ধার করে নেওয়া হয় স্থানীয় হাসপাতালে।
 
এরপর মামুন নিজেও মামলা করেন অপহরণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। 

 

সূত্র জানায়, তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের সাত মাস পর, ২০২৫ সালের ২১ মার্চ ভালুকা মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ৩৯৫ জনকে আসামি করা হয়। মামুন ছিলেন ওই মামলার ১০ নম্বর সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী।

এতসবের পরও মামুন মিয়ার নাম নেই ‘জুলাই যোদ্ধা’ তালিকায়। এই বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ জানিয়েছেন তিনি। 

মামুন মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, আমি তোফাজ্জলের হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। আমার চোখের সামনেই আওয়ামী লীগের লোকজন তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। সেদিন তারা চলে যাওয়ার সময় আমি সাহস করে একটি ভিডিও ধারণ করি। এরপর টেলিভিশন ও পত্রিকায় বলি ঘটনার কথা।

এই সাহসী উদ্যোগের পরিণতি ছিল ভয়াবহ। 

মামুন জানান, একদিন কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে আমাকে চোখ বেঁধে তুলে নেওয়া হয়। তারা আমাকে আটকে রেখে অনেক নির্যাতন করে। আমার পায়ের নখগুলো পর্যন্ত তুলে ফেলে।

মামুন আজও সেই শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা বহন করে চলেছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় কষ্ট, আন্দোলনের এত ত্যাগের পরও তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

তিনি আরো বলেন, আমি আন্দোলন করেছি, নির্যাতন সহ্য করেছি, জীবন বাজি রেখেছি। কিন্তু আজ সেই ‘জুলাই যোদ্ধা’ তালিকায় আমার নাম নেই। এটাই আমার কষ্ট। 

মামুনের মা রাহিমা খাতুন আতঙ্কিত কণ্ঠে বলেন, আমার পোলার বাঁচন তো কঠিন আছিল। আল্লাহই বাঁচাইয়া আনছে। কিন্তু এই যে এতকিছু করল, এখনো স্বীকৃতি নাই। এ যেন দুর্ভাগ্য। 

এদিকে মামুনের নাম ‘জুলাই যোদ্ধা’ তালিকায় না থাকায় ক্ষোভ জানিয়েছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। তারা বলছেন, যে তরুণ নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তাকে স্বীকৃতি না দেওয়া অবিচার। তাদের দাবি দ্রুত মামুনকে তালিকাভুক্ত করা হয়।

সচেতন মহলের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. শহীদুল্লাহ খান বলেন, অপহরণের পর আহত অবস্থায় উদ্ধারের পর যখন মামুন অসুস্থ হয়ে বাড়িতে তখনও তার খোঁজ নেয়নি কেউ। যে মামুন গার্মেন্টস করে সংসারের হাল ধরেছিলেন, সেই এখন বাড়িতে বেকার। মামুনের স্বীকৃতি যেমন দরকার, তেমনি তার একটা স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হওয়া উচিত। 

এ প্রসঙ্গে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গ্যাজেটের কার্যক্রমের সময় যখন তালিকা হয়, সে সময় তালিকায় মামুনের নামটি সংগত কারণে আসেনি। এখন যেহেতু বিষয়টি জানতে পেরেছি, মামুন মিয়াকে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।