Image description

১৩ জুন গভীর রাত। ইসরাইল শুরু করে একের পর এক লক্ষভেদী হামলা। শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—অসংখ্য প্রাণ ঝরে যায় মুহূর্তে। মৃত্যুর সংখ্যা পেরিয়ে যায় এক হাজারের ঘর। আর তারপর, ২২ জুন—যুদ্ধে সরাসরি প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো হয় বোমা হামলা। জবাবে, দেরি না করে ইরানও পাল্টা আঘাত হানে—ইসরাইলের দখলকৃত অঞ্চল আর কাতারে অবস্থিত আমেরিকান এয়ারবেইসে।

এভাবেই শুরু, তারপর একের পর এক ঘটনা—হুমকি, পাল্টা হুমকি, সাময়িক থেমে আবার বিস্ফোরণ। কেউ কাউকেই ছাড়তে রাজি নয়। এরই মাঝে আসে ২৪ জুনের যুদ্ধবিরতি। তবে এই বিরোতি কি সত্যিকার অর্থে শান্তির সূচনা, নাকি সামরিক নিস্তব্ধতার ভেতরে জমে থাকা এক বৃহৎ ঝড়ের পূর্বাভাস—এই প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ, তেহরান বারবার জানিয়ে দিয়েছে—যেকোনো আগ্রাসনে তাদের জবাব হবে কঠিন। এবং তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে পুরো ইরান।

সংবাদমাধ্যম মেহের নিউজ-এর বরাতে জানা যায়, ইরান-ইসরাইল সংঘাতের ৪০তম দিনে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই এক ভাষণে বলেন, "ইরান তার শিকরের দৃঢ়তা দেখিয়েছে। শত্রুরা যা-ই বলুক, আমরা বিশ্বাস, জ্ঞান ও ঐক্যের শক্তিতে এগিয়ে যাব। আমরা কাউকে ছাড় দেব না।" তিনি স্পষ্ট জানান, পারমাণবিক ইস্যু কিংবা মানবাধিকার কেবল অজুহাত। আসল ভয় পশ্চিমাদের—ইরানের নতুন চিন্তাধারা, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক সক্ষমতা। অর্থাৎ, ইরানের এগিয়ে যাওয়াকে রুখতেই এই সংঘাত শুরু করেছে পশ্চিমারা।

 

তবে এবার যদি আবারও আঘাত আসে—ইরান যে পাল্টা জবাব দেবে, তা হবে ভয়াবহ। প্রশ্ন উঠছে—এই বক্তব্য কি কেবল অভ্যন্তরীণ জনতাকে আশ্বস্ত করার ভাষণ, নাকি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে শক্তির প্রকাশ?

 

এ যুদ্ধে ইরান দেখিয়েছে, সে আর শুধু প্রতিরক্ষামূলক খেলোয়াড় নয়। আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আঘাত হানার দক্ষতা তাকে আঞ্চলিক শক্তি থেকে গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক প্লেয়ারে পরিণত করছে। একের পর এক নতুন মিসাইল নির্মাণ, সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আধুনিক যুদ্ধপ্রযুক্তি—ইরান তাদের শক্তির বার্তা স্পষ্টভাবে দিচ্ছে। আর ঠিক এই সামরিক শক্তির বিকাশকেই পশ্চিমারা তাদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে।

ড্রোন, সাইবার হামলা, স্যাটেলাইট ডেটা—সবক্ষেত্রেই ইরান আধুনিক যুদ্ধকৌশলের দিক থেকে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। শুধু সামরিক নয়, এটা ভবিষ্যতের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতিও। এর ভেতরে মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র স্মার্ট সিটি বসুন্ধরার মতো আধুনিক কাঠামো ইঙ্গিত দেয়—কে প্রযুক্তিতে এগিয়ে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রমাণ করেছে এই যুদ্ধ কেবল ইসরাইল বনাম ইরান নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর শক্তির সংঘাত—যার পেছনে কাজ করছে বৈশ্বিক প্রভাব বলয়ের নিয়ন্ত্রণের খেলা। নিষেধাজ্ঞার শ্বাসরোধী চাপের মধ্যেও ইরান পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। শুধু সামরিক নয়, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক জবাবের মাধ্যমে তারা বুঝিয়ে দিচ্ছে—তাদের ভাঙা সহজ নয়।

এই যুদ্ধ মুসলিম বিশ্বের সামনে ছুঁড়ে দিয়েছে একটি বড় প্রশ্ন—তারা কোন পক্ষে দাঁড়াবে? একই সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের ভূমিকাও ভবিষ্যতের বৈশ্বিক মেরুকরণের রূপরেখা নির্ধারণ করবে।

১২ দিনের মিসাইল যুদ্ধ হয়তো এখন থেমে আছে। কিন্তু রাজনৈতিক আগুন এখনো দাউদাউ করে জ্বলছে। খামেনেইর ঘোষণা শুধু শোকসভায় উচ্চারিত কিছু ধর্মীয় বাক্য নয়—এটা ভবিষ্যৎ কূটনীতির জন্য এক কাঠামোগত ড্রাফট। যেখানে একদিকে ইরান বলছে, ‘আমরা শক্ত, আমরা ঐক্যবদ্ধ।’ আর অন্যদিকে আমেরিকা ও ইসরাইল পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে—তারা পিছু হটার পাত্র নয়।

অতএব, এই যুদ্ধ কেবল ১২ দিনের কোনো দ্বন্দ্ব নয়—এটা আগামী দশকের আঞ্চলিক ভূরাজনীতির এক মহড়া। এখন প্রশ্ন হলো—খামেনেইর ‘শিকরের দৃঢ়তা’ কি সত্যিই শান্তির ফুল ফোটাবে, নাকি মধ্যপ্রাচ্যকে টেনে নিয়ে যাবে আরেকটা ভয়াবহ যুদ্ধের আগুনে? বাকিটা নির্ধারণ করবে সময়।