
চট্টগ্রামের মুরাদপুরে এক সংখ্যালঘু পরিবারের প্রায় ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ জায়গায় দখল করে ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। জায়গাসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আদালতে একটি মামলা এরইমধ্যে চলমান রয়েছে। তবে নতুন করে ভাঙচুর ও দখলের ঘটনায় থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী পরিবার।
কিন্তু যার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ- তিনি দাবি করেছেন, এ জায়গা তার নামে দলিলভুক্ত। তিনি গ্যাস, বিদ্যুৎসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সব সংস্থায় রাজস্ব পরিশোধ করে আসছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৩টায় নগরের পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুরের ১ নম্বর গেট এলাকায় এই হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। যার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তার নাম মো. মহিউদ্দিন চৌধুরী।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সকালে সরজমিনে দেখা গেছে, ওই বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই বড় উঠানজুড়ে ভাঙা ইট ও বাড়ির আসবাবপত্র এলোমেলো করে ছড়িয়ে ছিটোনো আছে। একটু সামনে হাঁটতেই ডান পাশের ভাঙ্গা দেয়ালের মাঝখান দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞের মত পাকঘর দেখা গেল। ফ্রিজ, খাট, আলমিরাসহ বাড়ির সব আসবাবপত্র কোনটা ভাঙা, কোনটা অর্ধভাঙ্গা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।nবাড়ির দেয়াল ও ছাদ অর্ধেক ভাঙা। পূজার আসনেও লেগেছে হামলার ক্ষত। ভেতরের তিনটি রুমে টিপটিপ করে বৃষ্টির পানি ঝরছে। বই খাতা, কাপড়-চোপড়, বাড়ির সব জিনিসপত্র ভাঙচুর অবস্থায় স্তূপ করা।
থানা সূত্রে জানা যায়, দখল ও ভাঙচুরের ঘটনায় মঙ্গলবার তিনজনকে আসামি করে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় একটি ফৌজদারি আইনে মামলা হয়েছে। এই মামলার বাদী হয়েছেন ভুক্তভোগী রঞ্জিত চৌধুরীর মেয়ে দেবী চৌধুরী। আসামি করা হয়েছে মো. মহিউদ্দিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতাকে কেএম মালি আকবর ও প্রতিবেশী আলমগীরকে।
মঙ্গলবার সকালে ওই বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ল ভাঙ্গা একটি পূজা মণ্ডপ ধরে অঝোরে কান্না করছেন ভুক্তভোগী রঞ্জিত চৌধুরীর মেয়ে বেবি চৌধুরীর দিকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কালবেলাকে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবারের বিকেল সাড়ে ৩টার কথা। বাসায় ছিলাম আমি, আমার বাবা, মা ও আমার দিদি এবং তার মেজো মেয়ে। ছোট মেয়েটা সবে মাত্র স্কুল থেকে আসছে, কিন্তু তাকে বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি আমার রুমে সোয়া ছিলাম। মহিউদ্দিনের স্ত্রী হঠাৎ করে এসে আমাকে ঘুম থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে বলছেন, চলে যা, চলে যা।
তিনি আরও বলেন, আমি রুম থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, এখানে অবস্থা তুলকালাম করে ফেলেছে। আমাদের বাসার সামনের অংশ অর্থাৎ প্রতিটি দেয়াল ভেঙে চুরমার। অন্তত ২ জন গুন্ডা নিয়ে তারা এখানে হামলা করছে। মুহূর্তে বাসার ভেতরে ঢুকে সব জিনিসপত্র ভাঙচুর করে চিত্তিসান করে ফেলেছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমি কোনোরকম বাসার ভেতর ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেই। আমার বড় ভাইকে ফোন করার পর তিনি পুলিশকে কল করে সব জানান। এর মধ্যে এসব সন্ত্রাসীরা লাগাতার আমাদের ঘর ভাঙছে, হামলা করছে। এ সময় আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে আমার পরিবারের বাকি সদস্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করি। তারা আমাদেরকে কোনো সময় দিচ্ছে না। এর মধ্যে আমাদের পরিবারের সব সদস্যকে মারধর করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। পরে পুলিশের সামনেই আমাদের ঘর ভেঙেছে।
কিন্তু তারা কোনো কিছুই বলেনি। আমাদের ব্যাপক অনুরোধের প্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের থামিয়ে আমাদের গেটে তালা মেরে চাবি নিয়ে চলে যায়। পুলিশের সামনেই মহিউদ্দিন চৌধুরী আমার ভাইকে হুমকি দিয়ে বলেছে, তোকে মেরে ফেলবো-কেটে ফেলবো। পরে পুলিশ এসে আবার চাবি দিয়ে যায়।
বেবি চৌধুরীর ভাই ভুক্তভোগী সুমন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, আমার নানারা দুই ভাই ছিলেন। একজন প্রেমলাল প্রজাপতি, অন্যজন বসন্তলাল প্রজাপতি। বসন্তলাল প্রজাপতি অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান। ফলে ওই ভাইয়ের সম্পত্তির মালিক হন আমার নানা প্রেম লাল প্রজাপতি। আমার নানার দুই মেয়ে- রত্না বালা প্রজাপতি ও রিনা বালা প্রজাপতি। রিনা প্রজাপতিও ছোটবেলায় (বিয়ের পূর্বে) মারা যান। ফলে ওনার সম্পত্তির মালিক হন ওয়ারেশমূলে আমার মা রত্না বালা প্রজাপতি। আমার মা-খালা দুজনের নামে পিএস ও বিএস খতিয়ান রয়েছে।
সুমন চৌধুরী আরও বলেন, যারা দখল করতে চাচ্ছেন তাদের বক্তব্য, তারা সেই জায়গা আমার নানির থেকে ক্রয় করেছেন। নানা বেঁচে থাকা অবস্থায় আমার নানি আরেকজন পুরুষের সঙ্গে চলে যান। সেই কষ্টে আমার নানাও মারা যায়। আমাদের ধারণা, এরপর আমার নানি তার দ্বিতীয় স্বামীর জোকসাজোসে এ সম্পত্তিগুলো বিক্রি করেছেন। কিন্তু এগুলো ১৯৫৮ কিংবা ৬০ সালে বিক্রি করেছেন কিনা আমরা জানি না। তবে যদি বিক্রি করে থাকেন, ওদের নামে কোনো পিএস রেকর্ড বা বিএস রেকর্ড করতে পারেনি। এখনো এসব সম্পত্তি আমার মায়ের নামে খতিয়ানভুক্ত।
তিনি বলেন, পিএস খতিয়ানের যে সম্পত্তি পাওয়া গেছে, সেগুলো অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে পাওয়া গেছে। বাদ বাকি পিএস রেকর্ড পর্যন্ত তারা বালামখাতা থেকে উধাও করে ফেলেছে। যদি সেগুলো পিএস খতিয়ানে লিপিবদ্ধ থাকতো তাহলে অন্তত আরো দেড়শ গন্ডা জায়গা সেখানে লিপিবদ্ধ থাকতো। কিন্তু পিএসের রেকর্ড না থাকায় শুধুমাত্র এ ১৭ গন্ডা জায়গা লিপিবদ্ধ হয়েছে। বাদবাকি সম্পত্তিগুলো আমরা আরএস রেকর্ডিংয়ের মালিক। আর এখানে যারা আছে তাদের কারো কাছে কোনো দলিল নেই, তারা সবাই দখলমূলে ভোগদখল করছে।
ভুক্তভোগী বেবি চৌধুরী বলেন, জায়গা নিয়ে যেই বিরোধিতা তা বিচারাধীন। তৃতীয় যুগ্ম জজ আদালতে সিভিল মামলা হিসেবে এটির বিচার প্রক্রিয়া চলছে। আমার মামলাটা এখনো শেষ হয়নি। আমি এখন পর্যন্ত মামলার সাক্ষী দিচ্ছি। রায় আসা পর্যন্ত সময় না দিয়ে তারা আদালত অবমাননা করে আমাদের বাড়ি ভাঙচুর করেছে। আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমার এখানে যা ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতিপূরণগুলো দিতে হবে।
তবে এসব অভিযোগ স্বীকার করেছেন মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। কালবেলাকে তিনি বলেছেন, ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ এবং ওসি প্রদীপের বোন রত্নবালা প্রজাপতি, দেবী চৌধুরী ও সুমন চৌধুরী পাঁচলাইশ থানা এলাকায় এসে ৪টা জায়গা দখল করে। এর মধ্যে একটা জায়গা আমার। এ বিষয় নিয়ে তৎকালীন পাঁচলাইশ থানার ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ সরকারিভাবে একটি জিডি করে। সেখানে ওসি প্রদীপ ও রত্না বালার নাম উল্লেখ আছে। সেই ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমার সঙ্গে অনেক মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে। এ পর্যন্ত তারা কোনো রায় ডিগ্রি হাসিল করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, এরইমধ্যে ৩টার রায় ডিগ্রি (বিভাগীয় কমিশনার, এডিসি ও এসি ল্যান্ড) আমার পক্ষে এসেছে। এখন পর্যন্ত তারা তাদের পক্ষে নামজারি করতে পারেনি। সেই রায় ডিগ্রিমূলে নামজারি, হোল্ডিং, গ্যাস, ওয়াসা, বিদ্যুৎ ও সিডিএসহ সবকিছু আমার নামে স্টাবলিশ হয়েছে। এর মধ্যেই ২০১৯ সালে তারা আরেকটি মামলা (৪৮/১৯) করেছে। এই মামলা তারা চালাতে চালাতে ২০২৪ সালে এসে আর এগোননি। ফলের তদবিরের অভাবে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।
সেই নকল কপিটা আমরা তুলে রেখেছি। এরমধ্যে তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, এখানে তারা আর থাকবে না। তারা একটা মোটা অংকের টাকা দাবি করেছে, এর বিনিময়ে তারা জায়গাটা ছেড়ে দিবে। ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে আমরা একটা এগ্রিমেন্ট করে তাদের সঙ্গে আপোষ করি।
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, সেভাবে তারা বৃহস্পতিবার টাকা গ্রহণ করে জায়গাটা খালি করে দিয়েছিল। তবে তাদের আত্মীয় সুমন চৌধুরী হঠাৎ এসে দাবি করেন- এই টাকা দিয়ে হবে না, আরও লাগবে। এরপর তারা আমাদের সঙ্গে হট্টগোল শুরু করে দেয়।
জায়গা ভাঙচুরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগ্রিমেন্টমূলে তারা আমার থেকে টাকা নিয়েছে। সেই হিসেবে আমার জায়গা আমি বুঝে নিয়েছি। এটি আমার জায়গা, এই কারণে আমি ভেঙেছি। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলে আমাদের হাত থেকে চাবিটা নিয়ে যায়। সন্ধ্যা সাতটায় মিটিং করার কথা ছিল থানায়। কিন্তু পুলিশ আমাদেরকে না ডেকে, কিছু না বলে চাবিটা আবার তাদের হাতে অস্থায়ীভাবে বুঝিয়ে দেয়। জায়গার সব ডকুমেন্ট আমাদের হাতে আছে। আমরা আসলেই নিরীহ।
তিনি আরও বলেন, সাম্প্রদায়িকতার ভয় দেখিয়ে আজকে ১০ বছর তারা আমাদেরকে আমাদের জায়গায় যেতে দেয়নি। এদের আইডি কার্ডের স্থায়ী ঠিকানা হলো, লালখান বাজারের তুলা পুকুর লেন। এখানে তারা ভূমিদস্যু।
চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, জায়গা নিয়ে মূলত তাদের সঙ্গে পূর্ব বিরোধ রয়েছে। তবে যে ব্যক্তি হামলা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে তার কাছে অনেক কাগজপত্র আছে। যারা ভুক্তভোগী, তাদের বাড়িঘরে হামলা করার ঘটনায় থানায় একটি মামলা হয়েছে। তবে ওই জায়গার পূর্বের কাগজ তারা আমাদের এখনো দেখাতে পারেনি।