Image description

ট্যুরিস্ট ভিসায় ঢাকা থেকে ইলেক্ট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশন (ইটিএ) নিয়ে গত জুন মাসে কলম্বো যান সাইফুর রহমান। কলম্বোর বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন লাইনে তিনিসহ আরও ৫ জন বাংলাদেশিকে আলাদা করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা। জিজ্ঞাসাবাদের এক ফাঁকে ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা ভিসার অপব্যবহার করছে, তাই এই জেরা। সাইফুর রহমান জানান, বাংলাদেশি পাসপোর্ট ছাড়া অন্য কাউকে এমন জেরার মুখে পড়তে হয় না।

অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধায় মানবপাচারে ব্যবহার হচ্ছে শ্রীলঙ্কা–নেপাল

শ্রীলঙ্কার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি নাগরিকদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধায় শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করে তৃতীয় দেশে অবৈধভাবে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। শ্রীলঙ্কার অন-অ্যারাইভাল ট্যুরিস্ট ভিসায় তৃতীয় কোনও দেশে যাওয়া অবৈধ। তৃতীয় দেশে যেতে হলে ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে। কিন্তু অন-অ্যারাইভাল ভিসা ব্যবহার করে এ কাজে প্রতিনিয়ত আটক হচ্ছেন বাংলাদেশিরা।      

গত এপ্রিলে তিন জন বাংলাদেশিকে আটক করে শ্রীলঙ্কার ইমিগ্রেশন। তাদের কাছে গ্রিসের ভুয়া পিআর কার্ড ছিল। গালফ এয়ারের কর্মকর্তাদের গ্রিসের পিআর কার্ড নিয়ে সন্দেহ তৈরি হলে তিন জন বাংলাদেশির তথ্য ইমিগ্রেশনকে জানানো হয়। পরে ইমিগ্রেশন তাদের আটক করে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করে। ওই তিন জন বাংলাদেশি বাহরাইন হয়ে গ্রিসে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে জানিয়েছেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদে ওই তিন জন বাংলাদেশি জানিয়েছেন— তারা পিআর কার্ড ইতালির এক ব্যক্তির কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন এবং গ্রিসে কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন।

এর আগে গত মার্চে ১০ জন বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করেছে শ্রীলঙ্কার ইমিগ্রেশন। তাদের বয়স ২০-৩০ বছরের মধ্যে। তারা ফেব্রুয়ারিতে অন-অ্যারাইভাল ট্যুরিস্ট ভিসায় সে দেশে প্রবেশ করেছিলেন। তবে তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে জানায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। ওই তিন ব্যক্তি বাংলাদেশ থেকে ভারতের চেন্নাই হয়ে কলম্বো পৌঁছান। তাদের পরিকল্পনা ছিল— শ্রীলঙ্কা থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর হয়ে লিবিয়া থেকে সমুদ্র পথে ইতালি যাওয়ার।

শুধু এই দুটি ঘটনা নয়, গত বছরের অক্টোবরে সার্বিয়ার ভুয়া ভিসা নিয়ে দোহা যাওয়ার পথে কলম্বো এয়ারপোর্টে আটক হন আরও ৮ বাংলাদেশি।  

গোয়েন্দা তথ্য ও মানবপাচার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা থেকে ভারতের চেন্নাই হয়ে কলম্বো রুট ব্যবহার অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় বেড়েছে। কারণ আগে সহজে ভারত ও দুবাইয়ের রুট ব্যবহার করা গেলেও বর্তমানে ভিসা জটিলতার কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই পাচারকারীরা বেছে নিয়েছে অন-অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা। বর্তমানে পাচারকারীদের কাছে বাংলাদেশিদের ইউরোপে পাঠানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট হচ্ছে শ্রীলঙ্কা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশ, এরপর তুরস্ক থেকে লিবিয়া হয়ে ইতালি।  

ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে এখন বাংলাদেশিদের নেপালে নিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে। নেপালে প্রবেশে অন অ্যারাইভাল ভিসা আছে, সেক্ষেত্রে সহজে পাচারকারীরা কাজের কথা বলে মানুষকে নেপালে নিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে সে দেশে ছয় মাস আটকে রাখা তিন বাংলাদেশি— হবিগঞ্জের তুহিনুর ইসলাম অনিক, রহিম খন্দকার ও শাকিব আহাম্মেদকে নেপালের অ্যান্টি ট্রাফিকিং ব্যুরোর সহায়তায় উদ্ধার করে দেশে ফেরত এনেছে ব্র্যাক। এ ছাড়াও মানবপাচারকারীরা বর্তমানে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, তিউনেশিয়া, রাশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, সার্বিয়ার মতো দেশ ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে।

সমুদ্রপথে ইউরোপে বেড়েছে মানবপাচার

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করছে যেসব দেশের মানুষ, বাংলাদেশ এখন সেই তালিকায় প্রথম।  জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৯ হাজার ৭৩৫ জন বাংলাদেশি সাগরপথে ইতালি প্রবেশ করেছেন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে এভাবে ইতালি প্রবেশ করতে গিয়ে লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি হয়ে অনেক বাংলাদেশি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। তাদের জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে অর্থ। ঘটছে প্রাণহানিও। তবে এত কিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এই প্রবণতা থামছে না। গত এক যুগে এভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গেছেন অন্তত ৭০ হাজার মানুষ।

তথ্য বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছানোদের মধ্যে ২২ শতাংশ ছিল বাংলাদেশি। আর এ বছরের একই সময়ে সেই সংখ্যা ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।  

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম বলছে,  এভাবে যারা ইউরোপে যাচ্ছেন—তাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বাংলাদেশের অন্তত ১০-১২টি জেলার লোক এভাবে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মরিয়া। এসব ক্ষেত্রে এখন সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকের নানা গ্রুপ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতারিতরা বা নির্যাতনের শিকার লোকেরা দেশে ফিরে মামলা করলেও মূল আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে।  

ঝুলে আছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মামলা

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবপাচার মামলা সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালেই মানবপাচার আইনে এক হাজার ৩৪টি নতুন মামলা হয়েছে। আর পুরোনো মামলা ধরলে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মামলা ঝুলে আছে। এর মধ্যে অন্তত ৩ হাজার মামলা বিচারাধীন এবং এক হাজারেরও বেশি মামলার এখনও তদন্ত শেষ হয়নি।  

মানবপাচারের ঘটনায় দায়ের মামলাগুলো মনিটরিং করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। সংশ্লিষ্ট বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মানবপাচারের অভিযোগে মামলা হয়েছে মোট ৪ হাজার ৫৪৬টি। এতে আসামি করা হয়েছে ১৯ হাজার ২৮০ জনকে। বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে সাজা হয়েছে কেবল ১৫৭ জনের। এর মধ্যে ২৪ জনের যাবজ্জীবন ও ১৩৩ জনকে দেওয়া হয়েছে অন্যান্য মেয়াদে সাজা। এসব মামলায় গুরুতর অভিযোগ থাকলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনও নজির নেই। এর বিপরীতে গত ছয় বছরে মানবপাচারের মামলায় খালাস পেয়েছে ৩ হাজার ১৪১ জন। সবচেয়ে বেশি আসামি খালাস পেয়েছে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  মানবপাচার সংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহি করার জন্য শক্তিশালী আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সজাগ ও সক্রিয় রয়েছে। সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে এবং পাচারের বিপদ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করার করার জন্য বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক প্রচারণা জোরদার করা হয়েছে।

উদ্বেগ আছে অন অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ নিয়ে  

ট্যুরিস্ট ভিসা অপব্যবহারের কারণে ভিসা বন্ধ কিংবা ভিসা পেতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় আগে অন-অ্যারাইভাল ভিসা দিতো বাংলাদেশিদের। তবে অন-অ্যারাইভাল ভিসার অপপ্রয়োগ করে তৃতীয় দেশে যাওয়া এবং মানবপাচার সংশ্লিষ্ট ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণে ইন্দোনেশিয়া অন-অ্যারাইভাল ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দেয়। এখন ভিসার জন্য আবেদন করলেও সময় লাগছে দুই মাসেরও বেশি। ফিলিপাইনেও আগে ১০ দিনের মধ্যে ভিসা মিললেও এখন সেটা পেতে দেড় মাস পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে।

ট্যুরিজম ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন— ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস এবং মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান বাংলাদেশি পর্যটকদের অতিরিক্ত সময় অবস্থানের অভিযোগ তুলে ভিসা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। থাইল্যান্ডের ই-ভিসা এখন প্রত্যাখ্যানের হার বেশি। মালয়েশিয়াও ভিসার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, আমরা ভিয়েতনাম, লাওস ও ইন্দোনেশিয়াসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এটি আমাদের জন্য শীর্ষ অগ্রাধিকারের বিষয়। তবে ভিসানীতি শিথিল করা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।

মানবপাচার একটি মূল উদ্বেগ বলেও জানান তিনি। তার মতে, এই উদ্বেগ বিশ্বব্যাপী দেখা যায়,  ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকি এশিয়াতেও। যখন একটি নির্দিষ্ট দেশ থেকে ভিসা জালিয়াতি এবং পাচারের ঘটনা শুরু হয়, তখন বিধিনিষেধ আসে।

তিনি জানান, ভিয়েতনাম এবং অন্যান্য দেশকে তাদের ভিসা পরিষেবা পুনরায় চালু করতে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে।

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। এভাবে ইতালি যাওয়ার পথে অনেক প্রাণহানি ঘটে। এ ছাড়াও লিবিয়ায় অনেক মানুষ ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। ক্যাম্পে বন্দি করে রেখে তাদের নির্যাতন করা হয়। এরপর পরিবারকে টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। বিদেশে কাজ বা শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার এটি ভয়াবহ সমস্যা। পাচারকারীরা এখন তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সেই তুলনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পিছিয়ে আছে। আবার পাচারের মামলাগুলোরও বিচার হচ্ছে না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশিদের নিয়ে বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশনে সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে, অন-অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করে দিচ্ছে। তারা মনে করে, বাংলাদেশিরা ভিসার অপব্যবহার করে, ঠিকমতো নিয়ম মানে না, অন্য দেশে চলে যায়। ভিসার বাংলাদেশিরা এমনভাবে অপপ্রয়োগ করে— যার ফলে ওই দেশগুলো নিরাপদবোধ করে না। বাংলাদেশিদের জন্য দরজা আসলে বিভিন্ন জায়গায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যাওয়া জরুরি।’