
মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার সন্তান সাহাদাত হোসেন মিশন। তিনি ঢাকায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করতেন। ভালোই চলেছিল তার দিনগুলো। গত বছরের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র -জনতার ডাকে সাড়া দিয়ে আর ঘরে বসে না থেকে ১৯ জুলাই সরাসরি আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। শিবচর উপজেলার শিরুয়াইল ইউনিয়নের পূর্বকাকৈর এলাকার সাহাদাত হোসেন মিশন পল্লি চিকিৎসক হুমায়ুন কবির খানের সন্তান। মিশন মা-বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মিশনের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার মধ্যে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে বিদায়ের মাধ্যমে এক দফা দাবি আদায় করা।
সরেজমিনে আহত সাহাদাত হোসেন মিশনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির পাশের রাস্তায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় তাকে। কখনো ক্র্যাচে ভর দিয়ে আবার কখনো ক্র্যাচ ছাড়া বাড়ির আঙিনা,পাশের রাস্তায় হেঁটে বেড়ান জুলাইযোদ্ধা আহত সাহাদাত হোসেন মিশন। অপেক্ষা কবে সুস্থ হবেন, হাঁটতে পারবেন স্বাভাবিক গতিতে। নাকি কখনোই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না । এমন প্রশ্ন তার চোখে-মুখে এখন।
জুলাই আন্দোলনে আহত সাহাদাত হোসেন মিশন বলেন, ‘আমি ১৮ জুলাই কাজের জন্য চট্টগ্রামে ছিলাম। ঢাকার অবস্থা জানার জন্য ফেসবুকে দেখেন। তখনো ইন্টারনেট চালু ছিল। যখনই আন্দোলন শুরু হয়, আন্দোলনের শুরু থেকেই আমি স্বৈরাচার হটানোর পক্ষে ছিলাম। মনে মনে প্রার্থনা করতাম স্বৈরাচারের অবসান হোক এ দেশে। হাসিনার অবৈধ থাবা থেকে মুক্তি পাক দেশ। এরপর আন্দোলন যখন বেগবান হচ্ছে, তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। ওই রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই।
১৯ জুলাই, ঢাকায় ফিরে সরাসরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দেই। তখন আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যাই। স্থানীয় ছাত্রদের সঙ্গে মিশে যাই আন্দোলনে। তুমুল আন্দোলন, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছে। আমি ছাত্রদের সঙ্গে মিছিলে রামপুরার দিকে অগ্রসর হই, তখনই পুলিশের গুলি বর্ষণ শুরু করে। একটি রাবার বুলেট এসে লাগে আমার ডান পায়ে। এরপর বাসায় ফিরে যাই ওই অবস্থায়। বাসায় চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে কাজ শুরু করি। কাজ শেষে আবার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছি। নিয়মিত আন্দোলনের খোঁজখবর রাখতাম। তিনি বলেন, ‘এরপর ৪ আগস্ট আন্দোলন যখন তুমুল , তখন বন্ধুদের নিয়ে আমি বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ি। আবার যোগ দেই আন্দোলনে। প্রথমে শাহবাগ পিজি হাসপাতালের দিকে যাই। ছাত্র-জনতার সঙ্গে যোগ দেই, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে। মিছিলের সামিল হতে হতে বিকাল ৫টার দিকে তেজগাঁও-কারওয়ান বাজারের মাঝামাঝি স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছিলাম। স্বৈরাচারী হাসিনা হঠানোর স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ তখন উত্তাল। মনে হচ্ছে জয়ের দ্বার প্রান্তে ছাত্র-জনতা । ঠিক ওই মুহূর্তে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ-বিজিবির মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ শুরু হয়।
অনেক মানুষ আহত হয়, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। এরই মধ্যে পর পর দুটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় আমার বাম পায়ে। বুলেট বিদ্ধ হওয়ার কারণেই মুহূর্তেই ভেঙে টুকরো হয়ে যায় বাম পা। পরে মানুষের সহযোগিতায় হাসপাতালে যাই। ১০ মাস ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। তবে আর কাজে যোগদান করা সম্ভব হয়নি তার। থমকে গেছে তার স্বাভাবিক জীবন, থেমে গেছে পরিবারের উপার্জনের অন্যতম চাকাও। এখন দিন কাটছে বাড়িতে, নিজ ঘরে। খুব একটা বাড়ি থেকে বের হন না তিনি। অপেক্ষা,পরিপূর্ণ সুস্থ হবার। সরকার যেন তার মতো জুলাইযোদ্ধাদের জন্য স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে এমনটাই দাবি করেন জুলাই আন্দোলনে আহত মিশন।
মিশন জানান, জুলাই ফাউন্ডেশন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়সহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক অনুদান পেয়েছেন। কিন্তু তার দাবি তার মতো আহতদের স্থায়ী কর্মসংস্থান দরকার। বর্তমান সরকারের কাছে আমি এই দাবি জানাচ্ছি। যাতে করে আমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারি। আমাদের যেন কারো কাছে হাত পাততে না হয়। এমনটাই প্রত্যাশা করেন জুলাইযোদ্ধা মিশন।
জুলাই আন্দোলনে আহত সাহাদাত হোসেন মিশনের বাবা মো. হুমায়ুন কবির খান বলেন, ‘৪ আগস্ট বিকালে ওর গুলি লাগার কয়েক ঘণ্টা আগেও আমি ফোন দেই ছেলেকে। আমার ছেলে বলে, ‘আমি আন্দোলনে যাচ্ছি, আব্বা আমি মারা গেলে আমার লাশ খুঁজতে আইসেন না। আমার জীবন আমি দিয়ে দেব, তবুও রাজপথ ছাড়ব না, ছেলে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল। তার রোজগারেই সংসার চলতো। সে আজ গুলিবিদ্ধ, পঙ্গু হয়ে বাড়িতে আছে। সরকারের কাছে দাবি ছেলের জন্য একটা স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। আর তাতে তাদের পরিবারের আর্থিক কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে বলে জানান হুমায়ুন কবির খান।