
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরীর জন্মদিন ছিল গত ৬ জুন। জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে একটি ব্যাগ কিনে দিয়েছিল তাঁর ও লেভেল পড়ুয়া বড় ছেলে আয়ান রশিদ।
আয়ান বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইনে টি–শার্ট বিক্রি করে। সে নিজের আয় দিয়ে মাকে ব্যাগটি কিনে দিয়েছিল। মাহেরীনের সেই ব্যাগ অক্ষত অবস্থায় তাঁর বাসায় পাঠিয়েছে মাইলস্টোন স্কুল কর্তৃপক্ষ। আর মাহেরীন ফিরেছেন দগ্ধ লাশ হয়ে।
২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুলের হায়দার আলী ভবনে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন শিক্ষক মাহেরীন।
গতকাল সোমবার রাত ১০টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো তথ্য বলছে, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ৪৫ জন ভর্তি ছিলেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকসহ অন্য প্রত্যক্ষদর্শীরা মাহেরীনের পরিবারকে জানিয়েছেন, স্কুলের একটি ভবনে (হায়দার আলী ভবন) বিমান বিধ্বস্তের পর আগুন ধরে যায়। মাহেরীন তখন শিশুশিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি নিজে অগ্নিদগ্ধ হন। রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে তিনি মারা যান।
প্রায় ১৭ বছর ধরে মাহেরীন মাইলস্টোন স্কুলে শিক্ষকতা করে আসছিলেন। মারা যাওয়ার আগে তিনি হায়দার আলী ভবনের বাংলা মাধ্যমের দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে ছিলেন।
মাহেরীনের স্বামী মো. মনসুর হেলাল। তিনি বলেন, বার্ন ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর কক্ষে তাঁর স্ত্রীকে প্রথমে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে ভর্তি স্কুলের এক শিক্ষার্থী মাহেরীনকে দেখেই বলেছিল, ‘এই টিচারই তো আমাদের আগুনের মধ্য থেকে বের করেছিলেন।’
মাহেরীন-মনসুর দম্পতির ছোট ছেলে আদিল রশিদ নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। হাসপাতালে মনসুর তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, তিনি অন্তত দুই ছেলের কথা চিন্তা করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতেন। তখন স্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন, স্কুলের বাচ্চারাও তো তাঁর সন্তান।

গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে মাহেরীন-মনসুর দম্পতির ভাড়া বাসায় যান প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। একটু পর বড় ছেলে আয়ান ট্রেতে করে চা-নাশতা দিয়ে যায়।
মনসুর বললেন, বাসায় কেউ এলে মাহেরীন কখনোই খালি মুখে যেতে দিতেন না। ছেলেদের ছোটবেলা থেকে এসব আদবকেতাসহ সব ধরনের কাজ করা শিখিয়েছেন মাহেরীন।
মনসুর বললেন, ঘটনার পর এক সপ্তাহ পার হয়েছে। তিনিসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা ছেলেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তবে বাস্তবতা হলো দুই ছেলে ও তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন, ক্ষতটা তো থেকেই যাবে।
প্যারাডাইস টেলিকম লিমিটেডের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত মনসুর। তিনি জানান, মাহেরীনকে বিয়ে করার আগে থেকেই তাঁরা বন্ধু ছিলেন। একই স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছেন। এরপর পড়াশোনা ও চাকরির জন্য একেকজন একেক দিকে চলে যান। তবে বন্ধুত্বটা অটুট থাকে। পরে পারিবারিকভাবে ২০০৮ সালের ১৯ নভেম্বর বিয়ে করেন তাঁরা।
বিয়ের তারিখটি ১৮ নাকি ১৯ নভেম্বর—এটা প্রায় প্রতিবছরই ভুলে যেতেন মনসুর। এ নিয়ে মাহেরীনের সঙ্গে তাঁর মান-অভিমান চলত।

মনসুর বললেন, ‘আমাদের তেমন অর্থবিত্ত নেই। নানান টানাপোড়েনের মধ্যেও আমরা শতভাগ সুখী ছিলাম। হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে নেওয়ার আগে মাহেরীন বলে গেছেন, ছেলেদের পড়াশোনা যাতে কোনোভাবে বন্ধ না হয়। ছেলেদের এখন যে বয়স, সে বয়সে মায়ের আদর-শাসনের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। অথচ ছেলেদের এই বয়সেই তাদের মা চিরতর চলে গেল।’
মনসুর জানান, ছোট ছেলে যখন একা থাকে, তখন সে মায়ের জন্য কাঁদে। এই ছেলেই মায়ের বেশি নেওটা ছিল। অন্যদিকে মাহেরীনকে হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে নেওয়ার আগপর্যন্ত মায়ের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখের অক্সিজেন মাস্ক ধরে রেখেছিল বড় ছেলে। একদম কাছ থেকে সে মায়ের কষ্টটা দেখেছে। দুই ছেলের সব আবদারই ছিল মায়ের কাছে। তাই ছেলেদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে সময় লাগবে।
বড় ছেলে আক্ষেপ করে বাবা মনসুরকে বলেছে, ঘটনার দিন তার মা তার মুঠোফোনে ফ্লেক্সিলোড করে দিতে চেয়েছিলেন। সেই মা কোথায় চলে গেলেন!
দুই ছেলের মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তাদের সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কথা বলা হয়নি।

মনসুর জানান, সকাল সাতটায় বাসা থেকে বের হতেন মাহেরীন। ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মতো বেজে যেত। নিজের হাতেই রান্না করতেন মাহেরীন। সংসারের অন্যান্য কাজও তিনি করতেন। নিজের পরিবার তো বটেই, মাহেরীন তাঁর ভাই-বোনদের কাছেও ‘মেন্টর’ ছিলেন।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে না গেলে মাহেরীন হয়তো এভাবে পুড়তেন না, বললেন মনসুর। তিনি বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাহেরীন বারবার নিজের দুই ছেলের কথা বলেছেন। তিনি যে গয়না রেখে গেছেন, ছেলেদের দরকারে তা বিক্রি করার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন স্বামীকে।
চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন মাহেরীন। ছোট ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী জানালেন, তাঁরা যেকোনো কাজ করার আগে বড় বোনের পরামর্শ নিতেন। মা–বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ঈদ বা যেকোনো উৎসবে সবাই এই বোনের বাসাতেই একত্র হতেন।
শরীরের শতভাগ পুড়ে গেলেও মাহেরীন হাসপাতালে স্বামীসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন, যতক্ষণ পেরেছেন। তবে চিকিৎসকেরা আগেই জানিয়েছিলেন, তাঁর বাঁচার সম্ভাবনা নেই।
মনসুর বলেন, তাঁর বড় ভাবি স্কুলটির আফতাব নগর শাখার শিক্ষক। ঘটনার পরপরই তিনি তাঁকে (মনসুর) ফোন করে জানান। তিনি মাহেরীনের মুঠোফোনে কল দিতে থাকেন। রিং হলেও কেউ ফোন ধরেননি। তখন মনসুর তাঁর বনানীর অফিস থেকে মোটরসাইকেলে করে রওনা দেন। অ্যাম্বুলেন্সচালক পরিচয়ে একজন ফোন দিয়ে তাঁকে জানান, মাহেরীনকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হচ্ছে।ছবি: মানসুরা হোসাইন

মনসুর বলেন, মাহেরীনের পুরো শরীর পুড়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের ৫২০ নম্বর কক্ষে ঢুকে তিনি দেখেন, মাহেরীন দুই হাত উঁচু করে শুয়ে আছে। মাথার চুলের প্লাস্টিকের ক্লিপ গলে লেগে গেছে। মুখটা তখনো চেনা যাচ্ছে। তাঁকে দেখেই মাহেরীন বলেন, ‘তুমি আসছ? আমি বাবা-মায়ের কাছে চলে যাচ্ছি।’
বিকেল পাঁচটার দিকে মাহেরীনকে বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। রাত পৌনে নয়টার দিকে তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার আগে তিনি স্বামীকে বলে যান, আগুন থেকে যতগুলো বাচ্চাকে পেরেছেন, উদ্ধার করার চেষ্টা করেন।
মাহেরীন হাসপাতালে চিকিৎসকদের কাছে নিজের আগের শারীরিক সমস্যাগুলোর কথা বলেছেন। বাবা-মায়ের কবরের পাশে কবর দেওয়ার কথা বলেছেন।
মাহেরীনের বাবার বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকার পৌর এলাকার বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়ায়। তাঁর বাবা প্রয়াত মহিতুর রহমান চৌধুরী। মা প্রয়াত সাবেরা চৌধুরী। বাবা-মায়ের কবরের পাশেই মাহেরীনকে কবর দেওয়া হয়।
মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষক নুসরাত জাহান জানান, ২১ জুলাই মাহেরীন ও আরেক শিক্ষককে উদ্ধারের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একটি কক্ষে নেওয়া হয়। তখন তাঁদের কাছে যান নুসরাত। মাহেরীন নিজেই তাঁদের হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেন। তখন তাঁকে জানানো হয়, অ্যাম্বুলেন্স এলেই হাসপাতালে নেওয়া হবে।
নুসরাত বলেন, ‘মাহেরীন মিসের সঙ্গে অনেক দিন ধরে কাজ করেছি। খুব কাছের ছিলেন তিনি। ভালো ছিলেন। যখন ধরতে যাই...সেদিনের কথা আর মনে করতে চাই না।’
২৪ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ি শাখার মারা যাওয়া দুই শিক্ষক মাহেরীন ও মাসুকা বেগমকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মাহেরীনের শেষ মুহূর্তগুলো স্মরণ করে মনসুর বলেন, মারা যাওয়ার আগে সে (মাহেরীন) তাঁর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু এমন পোড়া যে, সেই হাত ধরারও উপায় ছিল না।
মাহেরীন নিজেই মনসুরের ডান হাত শক্ত করে ধরে বুকের ওপর রেখে বলেন, ‘আমি চলে যাচ্ছি, জীবনে তোমার সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না।’
মারা যাওয়ার আগে অনেক খিদে পেয়েছিল জানিয়েছিলেন মাহেরীন। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থা তখন এতটাই খারাপ ছিল যে তাঁকে পানি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেননি মনসুর।
মনসুর জানান, মাহেরীন দুই ছেলেকে সব সময় বলতেন, পড়াশোনা শেষ করে নিজেদের পছন্দমতো পেশা বেছে নিতে পারবে। কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হবে না। আর সব সময় ভালো মানুষ হতে বলতেন।
মনসুর-মাহেরীন দম্পতির বাসার বসার ঘরের দেয়ালে স্বামী-স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে ২০১৫ সালে তোলা একটি ছবি বাঁধাই করে রাখা। খাবার ঘরের টেবিলের পাশের দেয়ালে এই দম্পতির বিয়ের একটি ছবি টানানো।
পরিপাটি করে মাহেরীন ঘর সাজিয়েছিলেন বলে জানালেন মনসুর। তিনি বলেন, ‘মাহেরীন অগোছালো কোনো কিছু পছন্দ করত না। এই যে দেখছেন, একেক জিনিস একেক দিকে, মাহেরীন থাকলে তা কখনো হতো না। এখন শুধু সংসার না, আমাদের জীবনটাই অগোছালো হয়ে গেছে।’