
দুষ্প্রাপ্য খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে চীনের আধিপত্য ভাঙতে মিয়ানমারের দিকে নজর দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যে অবস্থিত হেভি রেয়ার আর্থ বা বিরল খনিজের বড় অংশ বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ)-এর নিয়ন্ত্রণে থাকায় ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাব উঠেছে। আলোচনার সঙ্গে যুক্ত চারজন মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স।
রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, প্রস্তাবগুলোর একটি হচ্ছে মিয়ানমারের শাসক জান্তা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে কাচিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তিচুক্তির পথ সুগম করা। অন্য প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র জান্তা সরকারকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি কেআইএ’র সঙ্গে কাজ করে, তাদের সঙ্গে সরাসরি সমঝোতায় যাবে। তবে দুটো প্রস্তাবের মধ্যে মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে সরাসরি আলোচনার সম্ভাবনা কম। কারণ ২০২১ সালে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করার পর থেকে দেশটির সেনাশাসকদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় যায়নি যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এখন পর্যন্ত কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই আলোচনাগুলো এখনো গোপন পর্যায়ে থাকলেও গত ১৭ জুলাই ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের অফিসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনায় আসে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সাবেক প্রধান অ্যাডাম কাস্টিলো, যিনি বর্তমানে মিয়ানমারে একটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। কাস্টিলো বলেন, চীনের সোনার ডিম পাড়া হাঁস হয়ে থাকা কাচিনের খনিজ সম্পদ নিয়ে এখন কেআইএ নিজেরাই বিরক্ত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।
তবে তা বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র। কাচিন অঞ্চল অত্যন্ত দুর্গম এবং পাহাড়ঘেরা—এমন একটি অঞ্চল যেখান থেকে খনিজ পণ্য ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাত্র একটি রাস্তা রয়েছে, যেটি চীনের নজরদারিতে। সেখানে যেকোনো বহিরাগত পদক্ষেপে চীনের বাধা দেওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। সুইডিশ বিশ্লেষক বারটিল লিন্টনার বলেন, ‘চীনের নাকের ডগা দিয়ে খনিজ বের করে ভারতে পাঠানোটা শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব। এই এলাকা পাহাড়ঘেরা, রাস্তা প্রায় নেই, আর চীন নিশ্চুপ থাকবে না।’
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আরেকটি প্রস্তাব এসেছে কাচিনের খনিজ প্রক্রিয়াজাতকরণে কোয়াডের সহযোগিতা ব্যবহার করার। এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চীনের প্রতিক্রিয়ার ভয়। অন্যদিকে, সু চির সাবেক উপদেষ্টা শন টারনেল দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেন জান্তার পরিবর্তে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সঙ্গে কাজ করে এবং সেই পথ ধরেই কাচিন অঞ্চল থেকে খনিজ আহরণে যুক্ত হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জান্তা সরকারও যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে আসা এই মনোযোগকে কাজে লাগাতে চাইবে। চলতি মাসে ট্রাম্প যখন মিয়ানমারের যুক্তরাষ্ট্রমুখী রফতানির ওপর ৪০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপের হুমকি দেন, তখন সেই হুমকি জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইংকে সরাসরি একটি চিঠিতে জানানো হয়। জবাবে তিনি ট্রাম্পের ‘শক্তিশালী নেতৃত্ব’-এর প্রশংসা করে শুল্ক কমানোর এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। এমনকি প্রয়োজন হলে আলোচনার জন্য প্রতিনিধি দল পাঠাতে প্রস্তুত বলেও জানান।
এরপরই জান্তাঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলেছেন, জান্তা প্রধানের ওই চিঠির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়া একদিকে মিয়ানমারে সেনাশাসনের বৈধতা দিতে পারে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের’ অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে।