Image description
৬-৭ বছর যাবৎ ওয়ার্কশপে শিকলবন্দী

স্বল্প দূরত্বে উন্নত যাত্রীসেবার লক্ষ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করার জন্য চীন থেকে ২০টি ডেমু ট্রেন আমদানি করেছিল রেল কর্তৃপক্ষ। যার ব্যয় ছিল ৬৫৪ কোটি টাকা। আমদানি করা ডেমু ট্রেনগুলো মাত্র পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যেই বিকল হতে শুরু করে। নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষ জনবল না থাকায় বারবার মেরামতের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিন বছর আগে স্থায়ীভাবে অচল হয়ে পড়ে সব ট্রেন। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের এমপি ও মন্ত্রীদের দ্রুত সিদ্ধান্তে কোটি কোটি টাকার এসব ট্রেন কিনে মূলত রাষ্ট্রের অপচয় করেছিল বিগত সরকার। বর্তমানে সবগুলো ডেমু ট্রেন নষ্ট হয়ে ওয়ার্কশপে শিকলবন্দী হয়ে পড়ে রয়েছে। এসব একেকটি ট্রেনের মেয়াদ ৩০ বছর হলেও কয়েক বছর গড়াতেই এসব ডেমু ট্রেনগুলো একের পর এক অচল হতে থাকে। রেল কর্মকর্তারা বলেন, বিগত ৫ বছরে ডেমু ট্রেন থেকে রেলের ১৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা আয় হলেও পরিচালনে খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

যোগাযোগ বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনার সময়ই ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এমনকি এসব ডেমু ট্রেন আমদানির সময় রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট অনেকেরই মতামত নেওয়া হয়নি। তাই সরকারের রাজস্ব খাত থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) কেনা বাবদ ৬৫৪ কোটি টাকা অনেকটা পানিতেই গেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শুধুমাত্র মোটা অংকের কমিশন আদায়ের লক্ষ্যে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা না করেই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ রেলওয়ে চীন থেকে আমদানি করা ডেমু ট্রেন দেশের রেলপথে ২০১৩ সালে চলাচল শুরু করলেও ৬-৭ বছর যাবৎ ওয়ার্কশপে শিকলবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে।

জানা যায়, আরামদায়ক কম দূরত্বে ভ্রমণের জন্য চীন থেকে আমদানি করা হয় এই ডেমু ট্রেন। ট্রেনগুলোর সামনে-পেছনে দুই দিকেই আছে ইঞ্জিন। স্বল্প দূরত্বে দ্রুত চলাচলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রেনগুলো রেলওয়েতে সংযোজন করা হয়। কেনার সময় চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি ছিল টানা ৩০ বছর ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু ২০১৩ সালের মাঝামাঝি ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করার পরপরই যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। এরপর থেকে নানা যান্ত্রিক ত্রুটি লেগেই ছিল ২০ সেট ট্রেনে। চলাচল অযোগ্য এসব ট্রেনে আয়ের চেয়ে মেরামত খাতে ব্যয় বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ২০১৯ সাল থেকে ডেমু ট্রেনে যাত্রী পরিবহন সেবা বন্ধ হয়ে যায়।

সরেজমিনে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকোমেটিভ ডেমু ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখা যায় ট্রেনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে পুরো এলাকা। ঘন জঙ্গলের ভেতর পড়ে থাকা ট্রেনগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খসে পড়েছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় আগাছায় ঢেকে গেছে ট্রেনগুলো। দেখলে মনে হয় নতুন, তবে বাস্তবে সম্পূর্ণ অকেজো।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ট্রেন কেনার আগে অন্তত ৩০ জন কর্মকর্তা দুই মাস অবস্থান করেন চীনে। অথচ সুদূর প্রসারী চিন্তা না করে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় অনুপোযোগী এই ট্রেনগুলো কেনা হয়। নিজস্ব সফটওয়্যারে বাংলাদেশে ডেমু চালানোর দায়িত্ব ছিল চীনা প্রকৌশলীদের। কোনো রকমে মেয়াদ শেষ করেই দেশে ফিরে যায় তারা। কিন্তু এই সময়ে ট্রেনের সংশ্লিষ্ট কাউকে কোনো প্রশিক্ষণও দেয়নি চীনা প্রকৌশলীরা। অচল ডেমু ট্রেন মেরামত, যন্ত্রাংশ ক্রয় ও জ্বালানি তেলের ব্যবহার দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও ওঠে সেই সময়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের তেলবাজ কর্মকর্তাদের কারনে তার কোনো সুরাহা হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তি স্বার্থ, যা এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলে এমন আরো প্রকল্প আছে জানিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান তাদের।
এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, রেল থেকে কখনোই প্রস্তাব ছিল না। এটা একটা পরিকল্পিতভাবে ওপর দিক থেকে ওহি নাজিল হয়েছে, রেলওয়েতে ল্যান্ড করেছে এবং প্রকল্পটা নেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের অতিঃ মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) মুহাম্মদ শফিকুর রহমান জানান, দক্ষ লোকবল সঙ্কটের কারণে এগুলো মেরামত ও অপারেটিং করা যাচ্ছেনা। পুরো ট্রেনে বিদেশি সফটওয়্যার থাকায় মেরামত করেও সুবিধা করতে পারছে না দেশের প্রকৌশলীরা। ৬৫৪ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হওয়ার পর ডেমু মেরামতের সক্ষমতা না থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এগুলো নিলামে বিক্রির পরিকল্পনা চলছে।
রেলওয়ের পাহাড়তলী কারখানা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, মেরামত বাবদ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪০ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ডেমুর জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ কেনা বাবদ ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪১ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। দুই অর্থবছরে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ৭৮১ টাকা ব্যয় হলেও কোনো কাজে আসেনি। অথচ ট্রেনগুলো এক দিন চললে তিন দিন বন্ধ থাকত। চট্টগ্রাম-নাজিরহাট ও চট্টগ্রাম-বিশ্ববিদ্যালয় রেলপথে চলাচল করলেও বহু দিন থেকে বন্ধ।

একসময় চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে চলাচল শুরু করলেও যান্ত্রিক ক্রটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ট্রেনগুলোর বড় অংশ মেরামত হতো চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকোশেডে। কিছু মেরামত কাজ চলে পার্বতীপুর কারখানায়। রেলওয়ের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ডেমুতে জ্বালানি খাতে বিপুল তেল ব্যবহার করার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চলাচল বন্ধ থাকার সময়ই দুই সেট ডেমু ট্রেনে ১ হাজার ৭১২ লিটার জ্বালানি তেল ও ৩২২ লিটার লুবঅয়েল ব্যবহার দেখানো হয়েছে। বন্ধ থাকা দুটি ডেমু ট্রেনের বিপরীতে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৬ টাকার যন্ত্রাংশ ক্রয় দেখানো হয়। যা ডেমু খাতে বড় ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।