
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারকে অবৈধ ঘোষণা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সর্বস্তরের জনগণের অভ্যুত্থান, টানা ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের উৎখাত, গুম-খুন-দুর্নীতির বিচারের অঙ্গীকার, অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকছে জুলাই ঘোষণাপত্রে। অন্তর্বর্তী সরকারের করা ঘোষণাপত্রের খসড়ায় থাকছে না কোনো দল বা ব্যক্তির নাম। আগামী পাঁচ আগস্টের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।
সূত্রমতে, ঘোষণাপত্রের প্রথম একটি খসড়া জুলাই মাসের শুরুর দিকে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দলের কাছে পাঠায় সরকার। দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সংশোধন করে আবার দলগুলোর কাছে চূড়ান্ত করতে পাঠানো হয়। তাদের মতামত দু-একদিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। এর ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে ৫ আগস্টের মধ্যে জারি করতে চায় সরকার।
সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই ঘোষণাপত্রের ২৭টি দফা রাখা হয়েছে। প্রথম খসড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আওয়ামী লীগকে উৎখাত করেছিল বলা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় খসড়া ‘নেতৃত্বের’ পরিবর্তে ‘ডাকে’ উল্লেখ করা আছে।
ঘোষণাপত্রে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধীদলগুলোর সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বিএনপির মতামতে ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিপ্লব, ৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের করা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
অভ্যুত্থানের চেতনায় দেশ গড়তে সংবিধানকে বাতিল বা সংশোধন করার কথা প্রথম খসড়া থাকলেও সংশোধনীতে মানবিক ও নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখতে সংবিধান সংস্কারের কথা বলা আছে। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন, আওয়ামী লীগের গুম-খুন-দুর্নীতির বিচারের অঙ্গীকার রয়েছে। অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের স্বীকৃতি রয়েছে।
চূড়ান্ত খসড়ায় সাংবিধানের প্রস্তাবনার মতো শুরুতেই বলা হয়েছে, পাকিস্তানের ২৩ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তবে প্রথম খসড়ায়, সাতচল্লিশের দেশভাগের উল্লেখ ছিল।
খসড়ার দ্বিতীয় দফায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যে আদর্শে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, তা ৭২-এর সংবিধান ও শাসনে হয়। তৃতীয় দফায় ৭৫-এর একদলীয় বাকশাল কায়েম; চতুর্থ দফায় সিপাহি জনতার বিপ্লবে বাকশালের অবসান; পঞ্চম দফায় সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ১৯৭৯ সালে ফেরে বহুদলীয় গণতন্ত্র। ষষ্ঠ দফায় এরশাদের সামরিক ও স্বৈরশাসনের বর্ণনা; সপ্তম দফায় একানব্বইয়ে গণতন্ত্র পুনর্বহাল; অষ্টম দফায় এক-এগারোকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফল আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
খসড়ার ১৪তম দফায় তিনটি ভুয়া নির্বাচনে ক্ষমতা দখলকারী সরকার জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া; ১৭তম দফায় হাসিনার শাসনামলে বিরোধী মত, জনগণকে চরম নির্যাতন-নিপীড়ন করা; ১৯তম দফায় এর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জনতার অভ্যুত্থান তুলে ধরা হয়েছে।
২০ ও ২১তম দফায় অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, জনতার অভিপ্রায়ে সরকার গঠিত হওয়া, যার বৈধতা দিয়েছে উচ্চ আদালত; ২৩তম দফায় আগামীর বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার; ২৪তম দফায় আওয়ামী লীগ আমলের সব গুম-খুন-দুর্নীতির বিচার; ২৫তম দফায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সংবিধান সংস্কার; ২৬তম দফায় সংবিধানে অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি এবং ২৭তম দফায় জুলাই ঘোষণা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলে গণ্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপির আজকালের মধ্যে স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে চূড়ান্ত করতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। জামায়াতের দলীয় ফোরামেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে চূড়ান্ত মতামত দেওয়ার কথা জানিয়েছে দলটির সূত্র। তবে এনসিপি জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া সরকারের কাছে দিতে পারে বলে জানা গেছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থান হওয়ার পর ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার ঘোষণা দিয়েছিল অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া নেতারা। এর আগের রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্রনেতাদের ডেকে জানান, ঐক্যের স্বার্থে সরকার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দলকে নিয়ে ঘোষণাপত্র তৈরি করবে এবং জারি করবে।
জুলাই গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবিতে গত ৮ মে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাও করে এনসিপি। এতে যোগ দেয় জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, খেলাফত মজলিসসহ অনেক দল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১০ মে রাতে যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত হয় এবং বলা হয়, ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। এজন্য পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছে।
সে সময়সীমা গত ১ জুলাই শেষ হওয়ার পর ১৩ জুলাই বিএনপি ও এনসিপিকে ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া পাঠায় সরকার। খসড়া না পাওয়ায় জামায়াত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালে দলটিকেও ঘোষণাপত্র প্রণয়নে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।