Image description

রাজধানীর গুলশানে শনিবার সন্ধ্যায়  চাঁদাবাজির সময় ৪ জনের সঙ্গে হাতেনাতে আটক হন ‘সমন্বয়ক’ আবদুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদ। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারের পর সংশ্লিষ্ট সংগঠনের পদ থেকে তাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। তার চাঁদাবাজির ঘটনা প্রকাশ পেলে তার নিজ জেলা নোয়াখালীতে বিষয়টি টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়। সরজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, রিয়াদের মূল বাড়ি নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের নবীপুর বাজারের দক্ষিণ পাশে। রিয়াদের বাবা ৮ বছর আগে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। এখন দিনমজুর। রিয়াদও চলতেন আর্থিক কষ্টে। তবে গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর বছর না যেতেই তার গ্রামের বাড়িতে উঠতে শুরু করে পাকা দালান। হঠাৎ এমন পরিবর্তনে বিস্মিত এলাকাবাসী। তারা জানায়, রিয়াদের দাদা ওয়ালীউল্যাহ ছিলেন রিকশাচালক। দাদার মতো তার বাবা আবু রায়হানও রিকশাচালক ছিলেন ৮ বছর আগে। তবে বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছেন দিনমজুর হিসেবে।

গত বছরের ৫ই আগস্টের আগে দিনমজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন তার পরিবারের একাধিক সদস্য। বাবা কঠোর পরিশ্রম করে ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছেন। স্বপ্ন ছিল ছেলে একদিন বড় চাকরি করে সংসারের হাল ধরবেন। রিয়াদের মা নাজমুন নাহার একজন গৃহিণী। তিনি একসময় সংসার চালাতে অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। দারিদ্র্য, অনটন লেগেই থাকতো তাদের পরিবারে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট রিয়াদ। বড় ভাই চট্টগ্রাম ফিশারিজ কোম্পানিতে চাকরি করেন। সহপাঠীরা জানিয়েছেন, স্থানীয় নবীপুর হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন রিয়াদ। পরে ভর্তি হন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সরকারি মুজিব মহাবিদ্যালয়ে। সেখানে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার হাতে ফুল দিয়ে ছাত্রলীগে যোগ দেন। পরে সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় গিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একপর্যায়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। হয়ে ওঠেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা। ধীরে ধীরে চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন। রিয়াদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পাল্টে গেছে আগের পরিবেশ। নেই আগের ভাঙাচোরা ঘর-দরজা। আগের ঘরের পাশে নির্মিত হচ্ছে পাকা ঘর। পাকা ঘর নির্মাণ করার পাশাপাশি রিয়াদ কিনেছেন দামি গাড়িও। ছেলে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করেছেন রিয়াদের মা-বাবা তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। রিয়াদের মা সামসুন্নাহার কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে বলেন, ‘আমরা না খেয়ে ওকে শহরে পাঠাইছি। ছেলেটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, ভালোই ছিল। টিভিতে দেখি আমার ছেলেকে পুলিশে ধরেছে।’ রিয়াদের পাশের বাড়ির এক বাসিন্দা বলেন, ‘রিকশা চালানোর মাধ্যমে যে পরিবার চলতো, দিন এনে দিন খেতে হতো; সেখানে ৫ই আগস্টের পর রিয়াদের বিলাসী জীবনযাপন, ছাদ ঢালাই করে পাকা বাড়ি নির্মাণ করা দেখে আমরা অবাক হয়েছি।’ জানা যায়, রিয়াদ ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক।

গত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সমন্বয়ক পরিচয়ে হয়ে ওঠেন চাঁদাবাজ। সমন্বয়কের মুখোশ পরে কীভাবে গ্রামের এক হতদরিদ্র রিকশাওয়ালা পরিবারের ছেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন এবং বিলাসী জীবনযাপন করে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন গ্রামবাসী। বিজবাগ এনকে উচ্চ বিদ্যালয়ের দাতা ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য দীন মোহাম্মদ এমএ বলেন তার বাবা আমাদের রিকশায় আনা-নেয়া করতো। এই সুবাদে তার ছেলের জন্য তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতাম। তার ছেলে আইন বহির্ভূত, ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড করলে তাকে ওই ভাবে সহযোগিতা করতাম না। সে আমাদের নোয়াখালীকে দেশে-বিদেশে ছোট করেছে। নবীপুর হাইস্কুলের সাবেক সভাপতি শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘আমার স্কুলের এই ছাত্রকে সবাই দান-খয়রাত করে পড়াতো, কারণ তার দরিদ্র রিকশাচালক বাবার পক্ষে পড়ালেখার খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। সে কীভাবে এত ভয়ঙ্কর চাঁদাবাজ হয়ে উঠলো তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’ সাধারণ পরিবার থেকে শহরে উঠে আসা ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে চাঁদাবাজি করে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া এমন আরও রিয়াদ সমাজের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিনা প্রশাসনকে তা খুঁজে বের করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সেনবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন ৫ই আগস্টের পর রিয়াদ এলাকায় এসেছিলেন বলে শুনেছি, তিনি এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেছেন। উচ্চ পদস্থ বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে তার ছবি রয়েছে বলে জেনেছি।