
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক শুল্ক আলোচনার অংশ হিসেবে দেশটির উড়োজাহাজ কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে কিছু উড়োজাহাজ আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে পাওয়া যাবে। গতকাল রোববার সচিবালয়ে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের এমন বক্তব্যে আকাশ থেকে পড়েছে খোদ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স!
নিজেদের বিমান কেনার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তারা অবগত নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বর্তমান আর্থিক অবস্থা, রুট সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনার বাস্তবতায় এত বিশাল একটি বহরের প্রয়োজন নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিমানকে ‘ট্রেড পলিটিক্স টুল’ হিসেবে ব্যবহার করছে। এমন হুটহাট সিদ্ধান্তে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে পড়বে বিমান, ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় চাপেও পড়তে হবে তাদের।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স জানায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বোয়িং কিংবা এয়ারবাসের কোনো উড়োজাহাজ কেনার অর্ডার করেনি। বোয়িং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ১৪টি উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল। যার মধ্যে ছিল অত্যাধুনিক ৭৮৭-১০ ড্রিমলাইনার এয়ারক্রাফট। সেই প্রস্তাবের ফিজিবিলিটি নিয়ে বিমানের টেকনো ফাইন্যান্স কমিটি কাজ করছে
বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে মোট ১৯টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং প্রতিষ্ঠানের ১৪টি এবং কানাডার ড্যাশ-৮-কিউ ৪০০ মডেলের পাঁচটি উড়োজাহাজ রয়েছে। বোয়িংয়ের উড়োজাহাজের মধ্যে বর্তমানে চারটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার এবং দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ আছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাস্তবিক অর্থেই বিমানের বহর বড় করা প্রয়োজন। কারণ, প্রতি বছর হজের মৌসুমে অনেক লাভজনক রুটের ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। তবে, ২৫টি উড়োজাহাজের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়ে বিশ্লেষণ না করে বলা যাবে না। মন্ত্রণালয় থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ ক্রয়ের বিষয়ে বিমানের মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়নি। যদি বিমানের কাছে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য জানতে চাওয়া হতো, তাহলে বিমান বিশ্লেষণধর্মী তথ্য প্রদান করতো। এমন হুটহাট সিদ্ধান্ত বিমানকে অর্থনৈতিক ও পরিচালনাগত ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
৩১ হাজার কোটির বড় ধাক্কা, সিদ্ধান্তটা কতটুকু বাস্তবধর্মী
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ২৫টি বোয়িং কেনার সিদ্ধান্তে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা পড়তে পারে। এক্ষেত্রে ২৫টি উড়োজাহাজের মধ্যে যদি বিমান বোয়িং ৭৩৭-এর মতো ১৫টি ন্যারো বডির (মাঝারি আকার) উড়োজাহাজ এবং বোয়িং ৭৭৭ বা ৭৮৭-এর মতো ১০টি ওয়াইড বডির (বড় আকার) উড়োজাহাজ কেনে, তাহলে প্রায় ২.৫৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে।
বর্তমানে একটি ব্র্যান্ড নিউ বোয়িং ৭৩৭ মডেলের বিমান ৭০ মিলিয়ন ডলার এবং বোয়িং ৭৭৭ মডেলের বিমান ১৫০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হচ্ছে। বিমান যদি ছাড়ও পায়, সেক্ষেত্রে তাদের ন্যূনতম আড়াই বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। এখানেই খরচের শেষ নয়। এই অতিরিক্ত বহর ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবল, প্রযুক্তিগত সাপোর্ট ও দীর্ঘমেয়াদে ফ্লাইট প্ল্যান দরকার। দরকার পাইলট এবং তাদের প্রশিক্ষণ, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

শিফট ও লং-হল বিবেচনায় একটি বড় ফ্লিট চালাতে প্রতি বিমানের জন্য অন্তত ৮-১০ জন প্রশিক্ষিত পাইলট প্রয়োজন। নতুন ২৫টি বিমান মানে আরও দুই শতাধিক পাইলট দরকার হবে, যা এখনই প্রশিক্ষণ ছাড়া সম্ভব নয়। এছাড়া, প্রতিটি বিমানে গড়ে ১০-১৫ জন কেবিন ক্রু হিসেবে ধরলে ধাপে ধাপে আরও ৩৫০-৪০০ জন নতুন ক্রু প্রয়োজন হবে। তাদের প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও ব্যবস্থাপনার খরচ রয়েছে। পাশাপাশি বিমানের নতুন ফ্লিট পরিচালনায় আরও প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার, গ্রাউন্ড সাপোর্ট ও পার্টস সাপ্লাই চেইন লাগবে, যেখানে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় আড়াই থেকে তিন বিলিয়ন ডলারের এই বিনিয়োগ কত বছরে শোধ হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রতিটি উড়োজাহাজ ক্রয়ে সরকারের পেমেন্ট স্কিম, বিমানের সম্ভাব্য রেভিনিউ এবং ব্যয় কাঠামো— বিষয়গুলো নিয়ে স্বচ্ছ বিশ্লেষণ জরুরি।
বর্তমানে একটি ব্র্যান্ড নিউ বোয়িং ৭৩৭ মডেলের বিমান ৭০ মিলিয়ন ডলার এবং বোয়িং ৭৭৭ মডেলের বিমান ১৫০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হচ্ছে। বিমান যদি ছাড়ও পায়, সেক্ষেত্রে তাদের ন্যূনতম আড়াই বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। এখানেই খরচের শেষ নয়। এই অতিরিক্ত বহর ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবল, প্রযুক্তিগত সাপোর্ট ও দীর্ঘমেয়াদে ফ্লাইট প্ল্যান দরকার। দরকার পাইলট এবং তাদের প্রশিক্ষণ, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) এ টি এম নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই বিমান বাংলাদেশে প্লেন সংকট রয়েছে। নতুন উড়োজাহাজ কেনা অবশ্যই দরকার। তবে, যেকোনো প্লেন কেনার আগে নানা ধরনের বিশ্লেষণ করতে হয়। বিশেষ করে যাত্রী প্রবাহ, নির্দিষ্ট রুটের চাহিদা ও সক্ষমতা বিবেচনায় নিতে হয়। এরপর যাচাই করতে হয় কোন মডেলের প্লেন সেই রুটে কার্যকর হবে। সেই বিশ্লেষণ ছাড়া শুধু রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক কারণে বিমান কেনা হলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় সংস্থার ওপর বোঝা তৈরি হবে।’
“এখানে বিমানকে ‘ট্রেড পলিটিক্যাল টুল’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে”— মন্তব্য করেন তিনি।

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এয়ারলাইন্সগুলোর উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের অধিকাংশ এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের পাশাপাশি এয়ারবাসও ব্যবহার করে। তারা প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্লেষণ করে। বাংলাদেশেও বোয়িংয়ের পাশাপাশি এয়ারবাসের বিকল্প যাচাই করা উচিত ছিল।’
‘আগেই ১৪ বোয়িং অর্ডার’ নিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছেন বাণিজ্য সচিব
গতকাল রোববার বোয়িং কেনার বিষয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘এই পরিকল্পনা (বোয়িং ক্রয়) সরকারের বেশ আগে থেকেই ছিল। আগে ১৪টি বোয়িংয়ের অর্ডার ছিল। পাল্টা শুল্ক ইস্যুতে সেই সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করা হয়েছে।’
তবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স জানায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বোয়িং কিংবা এয়ারবাসের কোনো উড়োজাহাজ কেনার অর্ডার করেনি। বোয়িং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ১৪টি উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল। যার মধ্যে ছিল অত্যাধুনিক ৭৮৭-১০ ড্রিমলাইনার এয়ারক্রাফট। সেই প্রস্তাবের ফিজিবিলিটি নিয়ে বিমানের টেকনো ফাইন্যান্স কমিটি কাজ করছে। তারা রুট প্ল্যানিংসহ রেভিনিউ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। তবে, যদি এই বিশ্লেষণের মধ্যেই সরকার ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে তারা।

বোয়িংয়ের পাশাপাশি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এয়ারবাসও তাদের ১০টি উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল বিমানকে। ওই সময়ে বিমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি এয়ারবাস কেনার সিদ্ধান্তকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। তবে, সরকার পরিবর্তনের পর আর ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ১৪টি অর্ডারের তথ্য সঠিক নয়।
বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার ঘোষণা দিয়েছে মানে এই নয় যে বিমান কিনে ফেলেছে। এটার মানে হচ্ছে সরকার কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। আগামী ১০-১৫ বছরের জন্য ২৫টি বা তার বেশি এয়ারক্রাফট লাগতে পারে। তবে, একদিকে যেমন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফট দরকার, সেটা ঠিক। আবার কী পদ্ধতিতে কেনা হবে, সেটিও দেখতে হবে। ক্রয়ের পদ্ধতিটা নির্ধারণ করতে হবে। যেহেতু এটি বিমান বাংলাদেশ ব্যবহার করবে, এয়ারক্রাফটটি কোন রুটে এবং কীভাবে ব্যবহার হবে, সেই পরিকল্পনা তাদেরই থাকা দরকার।’
‘যেহেতু একটি কোম্পানি থেকে প্লেন কেনা হবে, সেক্ষেত্রে এয়ারক্রাফটের দাম কতটুকু প্রতিযোগিতামূলক হয়, সেটিও দেখার বিষয়। বোয়িং ও এয়ারবাস— দুই প্রতিষ্ঠান থেকে এয়ারক্রাফট কেনা গেলে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য পাওয়া যেত’— মন্তব্য এই এভিয়েশন বিশেষজ্ঞের।