
রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বিত কার্যক্রমের পাশাপাশি মুখ্য ভূমিকা রাখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো জুলাই আন্দোলনের গণ-আকাঙ্ক্ষা ছিল জনমুখী, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসব মন্ত্রণালয়ের অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সেই প্রত্যাশাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বিশেষ করে এসব দপ্তর পরিচালনার নেতৃত্বে থাকা কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা অধিকাংশ কর্মকর্তাই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮২ ব্যাচের সদস্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান প্রশাসনে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যাচ হিসেবে পরিচিত প্রশাসনের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারা। প্রায় এক দশক আগে এ ব্যাচের কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়া শুরু করলেও অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সখ্যতার কারণে তারা চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের অধিকাংশই সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারের অভ্যন্তরে এ ব্যাচের যথেষ্ট প্রভাব বলয় গড়ে উঠেছে। এ ব্যাচের কর্মকর্তারা সামলাচ্ছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব দপ্তর। তবে এসব দপ্তরের নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড সরকারকে বারবার প্রশ্নের মুখে ফেলছে। ফলে প্রশাসনে ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তাদের প্রাধান্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
চলতি বছরের ২৬ জুন বিতর্কিত পরিপত্র জারির পর সমালোচনার মুখে নতুন একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এদিন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দিনটিকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ৮ আগস্ট নতুন বাংলাদেশ দিবস পালনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। একই সঙ্গে ৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আরেকটি পরিপত্র জারির মাধ্যমে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ পালনের সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। এ রকম বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বর্তমানে সরকারের এ বিভাগের প্রধান প্রশাসন ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. শেখ আব্দুর রশীদ। তিনি সরকারের সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ পান গত ১৬ অক্টোবর। তিনি সরকারের ২৫তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতিতে প্রায় এক বছর ধরে নিয়মিতভাবে সমালোচনার মুখে পড়ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ছয় মাসে পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে আরো অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে ১ হাজার ৯৩০টি খুন, ৩৬৬টি ডাকাতি, ৯৭০টি ছিনতাই, ১১ হাজার ৮টি নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ৫১৫টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া সম্প্রতি গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেখানে সংঘটিত সহিংস ঘটনা তদন্তে ১৭ জুলাই স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এরপর সমালোচনার মুখে পড়ে ২৪ জুলাই ঘটনা উদ্ঘাটনে সাবেক এক বিচারপতির নেতৃত্বে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যক্রম নিয়েও বিভিন্ন মহলে রয়েছে তীব্র সমালোচনা। মন্ত্রণালয়টির শীর্ষ কর্মকর্তা নাসিমুল গনি সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিও ১৯৮২ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। কর্মজীবনের প্রথম ধাপে নাসিমুল গনি মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কাজের পাশাপাশি বিদেশী মিশনে কাজ করেছেন। এছাড়া জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার মো. জমিরউদ্দিন সরকারের একান্ত সচিব, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালে অতিরিক্ত সচিব থাকা অবস্থায় তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। এর চার বছর পর ২০১৩ সালে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় আওয়ামী লীগ সরকার।
বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ১২ আগস্ট আলী ইমাম মজুমদার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পান। পরে ১৬ আগস্ট তিনি সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রশাসন ঢেলে সাজানোর কাজে প্রধান উপদেষ্টাকে সহযোগিতা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন তার একজন সাবেক ব্যক্তিগত সহকারীকে। আর প্রশাসনে ৮২ ব্যাচের পুনরুত্থান ঘটেছে এর পর থেকেই।
৮২ ব্যাচের বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালের মে মাসে। পরে ওই বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এরপর পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত প্রার্থীদের নিয়োগ কার্যক্রম চলে ১৯৮৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। এ পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগকৃতরা ‘১৯৮২ ব্যাচ’ নামে পরিচিত। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে পাবলিক সার্ভিস কমিশন আরেকটি বিশেষ অনিয়মিত পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারি করায় এই ব্যাচকে পরবর্তী সময়ে ‘১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচ’ বলেও অনেকে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য, এ ব্যাচই ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসের আদলে গৃহীত ১৬০০ নম্বরের পরীক্ষায় নির্বাচিত বাংলাদেশের সর্বশেষ ব্যাচ। এরপর পাবলিক সার্ভিস কমিশন সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে পরীক্ষার নম্বর কমিয়ে আনে।
প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করছেন প্রশাসনের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা মো. সিরাজ উদ্দিন মিয়া। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৭ আগস্ট সাবেক মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার চুক্তি বাতিল করা হয়। ২ অক্টোবর এ পদে নিয়োগ পান মো. সিরাজ উদ্দিন মিয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এ কর্মকর্তা ২০০৯ সালে যুগ্ম সচিব অবস্থায় ওএসডি হন। পরে ২০১৬ সালে তিনি অবসরে যান।
সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকে ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তাদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) প্রাক্তন রেক্টর একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার পরিচালনায় নানা ক্ষেত্রে সচিবদের ভূমিকা থাকে। বদলি, পদোন্নতি, নিয়োগ এগুলো গোছানোর দায় শতভাগ সচিবদের। তারা সংস্কারগুলো তৈরি করে, প্রস্তাব দেয়। তবে ওপরের দিকে গিয়ে দুই-একটা পরিবর্তন হতে পারে। সার্বিকভাবে বললে গুরুত্বপূর্ণ এসব মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কিছু ব্যর্থতা আছে। যেমন গোপালগঞ্জের ঘটনায় যখন স্বরাষ্ট্র সচিবকে প্রধান করে কমিটি করা হলো তখন তিনি নিজেই বলতে পারতেন যে আমি নিজে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন-শৃঙ্খলার দায়টা আমার কাঁধে। নিজের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে আমি কী করে তদন্ত করি! এ রকম ভুল-ত্রুটি যে নেই তা নয়, অনেক ভুল-ত্রুটিই তাদের আছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস বা এ জাতীয় বিষয়গুলোয় সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার কোনো ভূমিকাই থাকে না। এটা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। জাতির জন্য খুবই বড় সিদ্ধান্ত সচিবদের কাছ থেকে আসে না।’
বর্তমান আমলাতন্ত্রে প্রশাসনের ৮২ ব্যাচের প্রাধান্যের বিষয়ে জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো কিছুই প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে নেই, এটা তো সত্য। মাইলস্টোনের ঘটনার পর সেখানে দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব আটকে থাকে, গোপালগঞ্জের ঘটনা, সচিবালয়ের ঘটনা—এসব বিবেচনা করলে বোঝা যায় দেশের সার্বিক অবস্থা। সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কোনো সংস্কারের বাস্তবায়ন চোখে পড়ছে না। শুধু জনপ্রশাসনের ৮২ ব্যাচ দিয়ে বিচার করলে হবে না, সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে কোনো কিছুই যে ফাংশন করছে না সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।’
বিগত সরকারের পথ অনুসরণ করে ঢালাওভাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি, চুক্তিভিত্তিক ও সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ অব্যাহত রেখে আলোচনার জন্ম দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পাশপাশি সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়ে তাদের তুষ্ট করার অভিযোগও উঠছে নানা মহলে। এছাড়া জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশমালা বাস্তবায়নের নির্দেশনা থাকলেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখা যাচ্ছে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েরও নেতৃত্বে রয়েছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেস উর রহমান। সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার এ কর্মকর্তা একজন হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট। চাকরিজীবনে তিনি মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কাজের পাশাপাশি বিদেশী মিশনেও কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব এবং সরকারি কর্ম কমিশনের সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের শিথিল ভাব সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার আমাদের যে দায়িত্ব দিয়েছিল আমরা সেটি করেছি। বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের তারা সেটি করবেন।’
বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জনপ্রশাসনের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মজীবনে মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। পাশাপাশি বিআরটিএর চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিমানের এমডি ও সিইও হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে কর্মরত মো. এহছানুল হকও প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের নেতৃত্বে রয়েছেন একই ব্যাচের সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তা এম এ আকমল হোসেন আজাদ।
৮২ ব্যাচের কর্মকর্তাদের কার্যক্রম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দিন শেষে দেশের সব সংস্কার ও কল্যাণমুখী উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ে আমলাতন্ত্রের কারণে। দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সেবা বিঘ্নিত করার কেন্দ্রে থাকার পরও তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় না। সব দায় ও দোষ রাজনীতিবিদদের ঘাড়ে চাপে, যদিও এটা পুরো চিত্র নয়। ইস্যুটা তাই শুধু ৮২ ব্যাচ, তাদের বয়স, যোগ্যতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি, অবসরে গিয়ে আবার কাজে ফেরত আসার বিষয় না—বরং পুরো জনপ্রশাসনের আমূল খতিয়ান নিয়ে পর্যালোচনা করা দরকার। আমরা দেখলাম যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও পর্যালোচনা আমলে নিয়ে বাস্তবায়ন করার কোনো উদ্যোগ নেই। জনপ্রশাসনকে স্বচ্ছ, দক্ষ ও জনমুখী করার জন্য অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক আলাপ ও তর্ক জরুরি।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জাতি অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। তবে তার পক্ষে এত কিছু সামাল দেয়া সম্ভব নয়। আমাদের দেশে যে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, কঠোর শাসনের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে সচিবদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে যে যিনি যে কাজের উপযুক্ত নন, তাকে সেই পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আবার শুধু সচিবের একার পক্ষে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার সঙ্গে বিরাট কর্মীবাহিনী আছে, সেগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এ জায়গায়ই ঝামেলা লেগে আছে। কাজেই কোনো একটি ব্যাচের সচিব নিয়োগ হলেই সার্বিকভাবে সব পরিবর্তন হয় না, তবে কিছুটা পরিবর্তন হয়। পুরো আমলাতন্ত্রই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে, আবার জনগণও তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। আসলে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে এগুলো নিয়ন্ত্রণ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিকতার কারণে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা অনেক জায়গায় ব্যাহত হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে আমলাশাসন চলছে, যার ফলে অনেক কিছুই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, অগ্রাধিকারে রয়েছে তাদের নিজেদের সুযোগ-সুবিধা। তাদের সব চাহিদাই শতভাগ পূরণ হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—আমলারা তো রাষ্ট্রের সার্বিক কর্তৃত্বের জায়গায় নেই। তারা নিজেদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন, কিন্তু তাদের এ সুযোগ করে দেয়া হয়েছে কেন? অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের নিয়ে আসা হয়েছে—উনারা এসেছেন কার মাধ্যমে? বিষয়টি তো অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরই বর্তায়। তাদের নিয়োগকর্তা অন্তর্বর্তী সরকার।’
অন্তর্বর্তী সরকারের এ নিয়োগ সংস্কৃতি নিয়ে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘তারা মুখে অনেক বিপ্লবী উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা বলেন এবং জনচাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কারের নানা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে তারা বেছে নিয়েছেন গতানুগতিক আমলাদের। আমলাদের মধ্যে ভালো কর্মকর্তা নেই—তা নয়। অনেক দক্ষ, উদ্যমী তরুণ কর্মকর্তা আছেন, যারা দেশের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করতে চান। কিন্তু সুযোগসন্ধানী আমলা নেতৃত্বের কারণে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় একটি গভীর সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেই জায়গায় প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে এবং এর বিস্তার ঘটেছে—যার দায় অনেকটাই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বর্তায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিকতার কারণে কাঙ্ক্ষিত অনেক অগ্রগতি হচ্ছে না। তার একটি বড় কারণ হচ্ছে যারা সুযোগসন্ধানী এবং সুবিধাসন্ধানী আমলা, তাদের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়িত করেছে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘গভর্নিং স্টাইল’-এর মধ্যেও সমস্যা তৈরি হয়েছে। কারণ ভালো কিছু করতে চাওয়া আমলারা বুঝে উঠতে পারছেন না যে তারা কোন সিগন্যাল মানবেন। একদিকে সরকার আমলাদের অতি ক্ষমতায়ন করেছে, অন্যদিকে তাদের প্রশাসনিক বার্তায় যাচ্ছে অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতা।’
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান তার মূল্যায়নে আরো বলেন, ‘আবার দেখা যাচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানের অতিমাত্রায় সুবিধাভোগী কিছু গোষ্ঠী আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নিজেদের স্বার্থে চূড়ান্তভাবে অপব্যবহার করেছে। এ সুবিধাসন্ধানী আমলারা ক্ষমতা পেয়ে কেবল নিজেদের সুবিধাই বাড়িয়েছেন, আর যারা সত্যিকার অর্থে সৎভাবে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম এগিয়ে নিতে চান, তারা পাচ্ছেন ভুল ও বিভ্রান্তিকর সিগন্যাল।’
মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সামর্থ্য ও সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা রাষ্ট্রকে ভালোভাবে রাখার ও চলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্য দিয়ে। বাস্তবতাটাও বুঝতে হবে।’ বর্তমান প্রশাসন ৮২ ব্যাচ নিয়ন্ত্রণ করছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাচের কিছু কর্মকর্তা সিনিয়র পজিশনে আছি। এখানে নিয়ন্ত্রণের কিছু নেই। আমরা পরিচালনা করছি।’