Image description

ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘জঙ্গি সংগঠন’, শরিয়াহ্ভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে ‘মৌলবাদী অর্থনীতি’ এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘জঙ্গিবাদের মূল নেতা’ হিসেবে অভিহিত করে প্রায় আড়াই দশক ধরে প্রোপাগান্ডা (উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার) চালান আবুল বারকাত। গত দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করা, শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তিসম্পন্ন শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংক দখল এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে জিয়াউর রহমানের চরিত্র হননের অন্যতম কুশীলব ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনৈতিক বয়ান তৈরিতে নির্জলা মিথ্যা আর চাতুরির আশ্রয় নেন। মিথ্যা বয়ানের পক্ষে তথ্যসূত্র না থাকায় নিজেই নিজের বক্তব্যকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি।

বারকাতের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বলেন, তিনি একজন ভারতীয় অনুচর, অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী। তাকে ইতিহাস বিকৃতকারী হিসেবেও অভিহিত করেন এই অধ্যাপক। আরেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, বারকাত এমনসব উদ্ভট তত্ত্ব তৈরি করেছেন, যা অর্থনীতির সঙ্গে যায় না। তিনি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মানুষকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। এজন্য জিয়াউর রহমান সম্পর্কে তিনি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বারকাত। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০০৯ সালে তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান। নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে তার আমলে জনতা ব্যাংক একটি দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকে পরিণত হয়। বর্তমানে ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন আবুল বারকাত। এ সমিতিকে ব্যবহার করেই তিনি ‘জঙ্গিবাদ’, ‘মৌলবাদী অর্থনীতি’সহ নানা ধরনের প্রোপ্রাগান্ডা চালান। এই অর্থনীতি সমিতি থেকে প্রকাশিত সাময়িকী ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’র ২০১৫ সালের জুনের ৩১তম সংখ্যায় ‘বাংলাদেশে মৌলবাদ ও মৌলবাদী জঙ্গিত্বের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামে ড. বারকাতের নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। মূলত ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ‘মৌলবাদ’ ও ‘জঙ্গিবাদ’ নিয়ে ড. বারকাত যত ধরনের লেখালেখি করেছেন (তার ভাষায় গবেষণা), সেসব লেখার নির্যাস হলো প্রকাশিত নিবন্ধটি। এ নিবন্ধেই বারকাতের যাবতীয় প্রোপাগান্ডা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নিবন্ধটিতে মোট ৬১টি তথ্যসূত্র ব্যবহার করেছেন বারকাত। এর মধ্যে ৩৬টি হচ্ছে তার নিজস্ব বক্তব্যের সমর্থনে দেওয়া নিজেরই লেখা। অর্থাৎ, তিনি এমনসব বক্তব্য দিয়েছেন, যেগুলোর সমর্থনে তিনি ছাড়া ভিন্ন কোনো সূত্র নেই।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (ওয়ান-ইলেভেন) আমেরিকায় টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার পরই পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষণা করে। পশ্চিমের ইসলামফোবিক মিডিয়া মুসলমান মানেই ‘জঙ্গি বা মৌলবাদী’ ট্যাগ দিয়ে নানা সংবাদ পরিবেশন শুরু করে। এরপর ক্রমান্বয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে সে বয়ান ছড়িয়ে দেওয়া হয় নানাভাবে। অবশ্য ওয়ান-ইলেভেন সংঘটিত হওয়ার আগে ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে আমেরিকান সরকারের ‘রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব’ তৈরি হয়। আর সে দ্বন্দ্বের জেরে ইসলামি দলগুলোর বিরুদ্ধে ‘মৌলবাদী’, ‘জঙ্গি’ তকমা দেওয়ার প্রবণতা শুরু হলে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশটিতেও পশ্চিমাদের সেই বয়ান তৈরিতে গবেষণার নামে প্রোপাগান্ডা শুরু করেন বারকাত। ‘সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী’ হিসেবে আমেরিকার বিরুদ্ধে তার প্রবন্ধে নানা ধরনের বক্তব্য থাকলেও আমেরিকার ‘মৌলবাদী’ ও ‘জঙ্গি’ তত্ত্ব প্রচারে কোনো ধরনের কার্পণ্য করেননি তিনি। বরং মনগড়া তথ্য দিয়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন অনবরত।

তার এমন মিথ্যার উদাহরণ হতে পারে পাকিস্তান সৃষ্টি ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিষয়ে বারকাতের বক্তব্য। তার প্রবন্ধে পূর্ববঙ্গে উদারনৈতিক ইসলাম থেকে ‘জঙ্গিবাদী’ ইসলামে রূপ নেওয়ার পেছনে তিনটি ঘটনাকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। এগুলো হলো—১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি, জিয়াউর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশ সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ স্তম্ভটি উচ্ছেদ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিতে না পারা। অর্থাৎ, পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে এ দেশের জনগণ একটি ‘জঙ্গিবাদী’ রাষ্ট্র তৈরির গোড়াপত্তন করেছেÑএমনটিই ধারণা দেন বারকাত। অবশ্য বর্তমানে এ দেশের এক শ্রেণির সুশীল সমাজ বারকাতের এ ধরনের মিথ্যা বয়ানকেই সত্য হিসেবে গ্রহণ করেছে।

অপরদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে সব সীমা লঙ্ঘন করেছেন এই অর্থনীতিবিদ। জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বারকাতের বক্তব্য হলোÑ‘১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত মূল সংবিধানের সাথে অবৈধ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষিত দ্বিতীয় ঘোষণা (সংশোধনী) অর্ডার ১৯৭৮ তুলনা করলেই বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, জিয়াউর রহমানই ছিলেন ইসলাম ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও মৌলবাদী জঙ্গিত্বের পুরোধা ব্যক্তি।’

বারকাত আরো লেখেন, ‘১৯৭২ সালের সংবিধানে যতটুকু ধর্মনিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ ছিল, সবকিছু অবৈধ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৭-৭৮ সালে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করে তার জায়গায় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করে ইসলামভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও মৌলবাদী জঙ্গিত্বের পথ সচেতনভাবেই সুপ্রশস্ত করলেন।’

অর্থাৎ, বারকাত এ দেশে জঙ্গিবাদের জন্য শুধু জিয়াউর রহমানকেই দায়ী করেননি; বরং তাকে তুলে ধরেছেন জঙ্গিবাদের প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে। শুধু তা-ই নয়, সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পরিবর্তে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ স্থাপনের জন্য জামায়াতের দৃশ্যমান নেতাদের গোপন নেতা ছিলেন কী নাএমন প্রশ্নও তোলেন তথাকথিত এই গবেষক। গত দেড় দশকে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের সঙ্গে জিয়াউর রহমান এবং বিএনপিকে জড়িয়ে যত ধরনের নেতিবাচক প্রচার চালানো হয়েছে, বারকাতের নিবন্ধ হচ্ছে সেসব প্রচারের উৎসমুখ।

মূলত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিয়ে সংবিধানে ‘আল্লাহর প্রতি আস্থা’ স্থাপন করায় বারকাত যারপরনাই ক্ষুব্ধ ছিলেন। দেশের তথাকথিত সুশীলরা জিয়াউর রহমানকে ‘অপরাধী’ প্রমাণের জন্য বারবার ৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দোহাই দিয়ে থাকেন। অবশ্য জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনা পদচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর নতুন করে সংবিধান রচনার কথা উঠেছে। কিন্তু বারকাতদের মতো সুশীলরা ইতিহাসের মিথ্যা বয়ান তৈরি করে এ দেশের জনমানসে জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি বিনষ্টের অপচেষ্টায় এখনো লিপ্ত রয়েছেন।

‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নীতি বাদ দেওয়ার কারণে জিয়াউর রহমান প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি না, না মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের অনুচর ছিলেন—এমন গুরুতর অভিযোগ তোলার পাশাপাশি ‘বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের’ স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন কি নাÑএমন প্রশ্নও তুলেছেন বারকাত। পতিত শেখ হাসিনা তার বিভিন্ন বক্তব্যে জিয়াউর রহমানসহ বিএনপির বিরুদ্ধে যেসব কথা বলতেন, তার সঙ্গে বারকাতের এসব বয়ানের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিএনপির আন্দোলনকে ‘জঙ্গি আন্দোলন’-এর তকমা দেওয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ও তার অনুগত মিডিয়ার যে প্রবণতা ছিল, তার অন্যতম উৎসস্থল ছিল বারকাতের এসব প্রোপাগান্ডা।

বারকাতের এসব প্রোপাগান্ডার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনীতি, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. এম শহীদুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, আবুল বারকাত একজন ভণ্ড; একজন মানসিক বিকৃত মানুষ। ইতিহাস সম্পর্কে তার তেমন ধারণা নেই। তিনি ইতিহাস বিকৃতি করেছেন। পাকিস্তানের প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে যাদের ভূমিকা রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বারকাত যেসব কথা বলেছেন, সেগুলোর বাস্তবসম্মত কোনো ভিত্তি নেই। আওয়ামী লীগ এ দেশের স্বাধীন সত্তা স্বীকার করে নাÑএটা এখন প্রমাণিত সত্য। বারকাত একজন ভারতীয় অনুচর, অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী। সেজন্য আওয়ামী লীগ ও বারকাত একই ধরনের তথ্য বিকৃতি করছে।

অভিজ্ঞরা বলছেন, বারকাত তার নিবন্ধে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রচার করেছেন, সেগুলো নিছক একজন ব্যক্তির মতামত, যা গবেষণা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। বরং তার প্রোপাগান্ডাকে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বয়ান হিসেবে গ্রহণ করেছে। এমনকি সাধারণ মানুষের মন-মগজে এসব ধারণা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রয়াসও ছিল। তার একটি উদাহরণ হতে পারে ‘ইনডেমনিটি’ নামে প্রচারিত একটি নাটক। ওই নাটকটি রচনা করেন মান্নান হীরা নামে এক নাট্যরচয়িতা। সেই নাটকে জিয়াউর রহমানকে একজন ভিলেন বা খলচরিত্র হিসেবে উপস্থাপনে বারকাতের প্রোপাগান্ডার স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। ওই নাটকটি দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রদর্শনেই শুধু সীমিত থাকেনি, ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যদল তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি মঞ্চায়নও করেছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন প্রিন্ট, অনলাইন মিডিয়ায় ‘ইনডেমনিটি : একটি কালো অধ্যায় ও একটি নাটক’ নামে প্রকাশিত নিবন্ধে নাট্যকার মান্নান হীরা জিয়াউর রহমানকে ভিলেন তৈরির সে নাটকটিকে ইতিহাসের ‘দায়ভার’ ঘুচানোর প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করেন। এভাবে ইতিহাসের ‘দায়ভার ঘুচানোর’ নামে বারকাতের মতো ‘সুশীল’রা আজও সমাজে সক্রিয় রয়েছেন নানা স্তরে।

বারকাত তার নিবন্ধে ইসলামি দলগুলোর বিরুদ্ধে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক তকমা লাগিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি ইসলামি শরিয়াহ্কে ‘তথাকথিত শরিয়াহ্’ আখ্যা দেওয়ার ধৃষ্টতাও দেখিয়েছেন। ইসলামি শরিয়াহ্ ব্যবস্থায় হিসাবের ক্ষেত্রে নানা ধরনের ফাঁকির মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে—এমন দাবি করে বারকাত লেখেন, ‘ধর্মের নামে হিসেব-পত্তর পদ্ধতি শরিয়াহ্ভিত্তিক করার ক্ষেত্রে নানান ফাঁকি-জুকি যা রেন্ট সিকিংয়ের নামান্তর মাত্রই শুধু নয়, তা রেন্ট সিকিংয়ের সর্বোচ্চ সহায়ক।’ সরকারি নীতি কিংবা অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে কারসাজির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের পদ্ধতিকে ‘রেন্ট সিকিং’ বলে। তিনি শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকিং কিংবা যে কোনো আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে অসাধুতা রয়েছে বলে মনে করেন।

‘মৌলবাদের অর্থনীতি’ নামে বারকাত এমন এক তত্ত্ব হাজির করেন, যা এর আগে কখনো কেউ শোনেনি। এটিকে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এক ঘনীভূত প্রকাশ উল্লেখ করে বারকাতের নিবন্ধে বলা হয়েছে, এটি অসাম্প্রদায়িকতা এবং ৭২-এর সংবিধানের মূল চেতনাবিরুদ্ধ। মৌলবাদী অর্থনীতি ও জঙ্গিত্বসহ সংশ্লিষ্ট রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক। তার দাবি, মৌলবাদের অর্থনীতির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো জঙ্গি অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা নিয়ে জঙ্গিরা নানাভাবে সক্রিয় রয়েছে।

মৌলবাদের অর্থনীতির সমাধান হিসেবে ১৫টি সুপারিশ করেন এই অর্থনীতিবিদ। তার মধ্যে রয়েছে—মৌলবাদের অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, বাজেয়াপ্তকরণ, আইনি হস্তান্তর, ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন, পর্ষদ পরিবর্তন ইত্যাদি। অর্থাৎ, শরিয়াহ্ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দখল করার ক্ষেত্রে ড. বারকাত আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎসাহিত করেন। এরই ধারাবাহিতায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইসলামী ব্যাংক দখলের ঘটনা ঘটে।

মৌলবাদের অর্থনীতির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতি সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি ড. মাহবুব উল্লাহ আমার দেশকে বলেন, আবুল বারকাত অর্থনীতির এমন সব উদ্ভট তত্ত্ব তৈরি করেছেন, যা অর্থনীতির সঙ্গে যায় না। তিনি অর্থনীতিতে মৌলবাদের যে তত্ত্ব দিয়েছেন, তার সঙ্গে অর্থনৈতিক কোনো কাঠামোর সঙ্গেই মিল নেই।

‘অর্থনীতি সমিতি’ ব্যবহার করে বারকাতের এসব তত্ত্বের প্রচারের বিষয়ে মাহবুব উল্লাহ বলেন, অর্থনীতি সমিতি গত ১৬ বছর ধরে বারকাতরা দখল করে রেখেছিলেন। তখন তারা তাদের খুশিমতো যা ইচ্ছা তা করেছেন, নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সমিতিকে ব্যবহার করেছেন। সমিতির ইতিহাসে এর আগে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি।

ইসলামী ব্যাংক দখলে বারকাততত্ত্বের ভূমিকার বিষয়ে এই অধ্যাপক বলেন, ব্যাংক দখল করেছেন শেখ হাসিনা, তার নির্দেশেই এটি হয়েছে আর বারকাত একটা চুনোপুঁটি মাত্র।

জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বারকাতের ঘৃণ্য বক্তব্যের বিষয়ে মাহবুব উল্লাহ বলেন, বারকাত জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মানুষকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। এজন্য জিয়াউর রহমান সম্পর্কে তিনি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।

‘মৌলবাদী অর্থনীতি’র বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, মৌলবাদী অর্থনীতির নামে যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়, সেগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য বৈ কিছুই নয়। রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে শরিয়াহ্‌ভিত্তিক ব্যাংকগুলো দখল করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি বলা মুশকিল। তবে রাজনৈতিক লুটেরা গোষ্ঠী ব্যাংকগুলো দখল করেছে।

টার্গেট করেই ইসলামী ব্যাংকগুলো দখল করা হয়েছে বলে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর মন্তব্য করেছিলেন আইন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ইসলামী ব্যাংকসহ ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার লুট করার জন্য ইসলামী ব্যাংকগুলো বেছে নেয়। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে ব্যাংকগুলোকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে প্রথম শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকিং চালু হয় ১৯৮৩ সালে। ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে চালু হওয়া এ ব্যাংকিং ব্যবস্থা গ্রাহকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কয়েক বছরের মধ্যে বেসরকারি খাতের শীর্ষ ব্যাংকে পরিণত হয় ইসলামী ব্যাংক। গ্রাহকের আগ্রহ বাড়তে থাকায় শরিয়াহ্ভিত্তিক আরো কয়েকটি নতুন ব্যাংক চালু হয়। শুধু তা-ই নয়, প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার পাশাপাশি কয়েকটি ব্যাংক শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা চালু করে। কিন্তু ইসলামি শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ধ্বংসে ‘মৌলবাদী অর্থনীতি ও জঙ্গিত্বের রাজনৈতিক অর্থায়ন’ নামক বয়ান হাজির করেন বারকাত। কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই তিনি শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে জঙ্গিবাদের অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেন।

২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি দখলের সময় ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকা আবদুল মান্নান আমার দেশকে বলেন, ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে যেসব কথা বলেছেন বারকাত, সেগুলো তার মনগড়া ও অসত্য বক্তব্য। বারকাত একা নন, একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী দিনের পর দিন নানা ধরনের প্রচার চালিয়েছে। তারা ছিল খুবই প্রভাবশালী। ইসলামী ব্যাংকের জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি ইসলামী ব্যাংকের এমডি থাকাকালে বারকাতকে এ বিষয়ে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম। ‍যদি তিনি এটি প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমিসহ ব্যাংকের কর্মকর্তারা পদত্যাগ করব। কিন্তু তিনি কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।

বারকাতের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক অধ্যাপক আমার দেশকে বলেন, বারকাত একজন স্ট্যান্ডবাজ। তিনি চটকদারি কথা বলতে পছন্দ করতেন। বাজার অর্থনীতি নিয়ে তার জ্ঞান একেবারে প্রাথমিক স্তরেও ছিল না। কিন্তু তিনি সস্তা কথা বলতে পছন্দ করতেন। তিনি এমন একটা ধারা তৈরি করার চেষ্টা করেছেন, যেগুলোর কোনো সারবত্তা ছিল না। তার অধিকাংশ লেখা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যেগুলোর সঙ্গে অর্থনীতির যোগসূত্র কমই ছিল। দুর্বৃত্তায়ন বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও বিগত শেখ হাসিনা রেজিমে উনি একেবারে নির্লিপ্ত ছিলেন। বরং বিগত রেজিমকে সহায়তা করার জন্য তিনি নানাভাবে সচেষ্ট ছিলেন।

বারকাতের গবেষণার বিষয়ে এই অধ্যাপক আরো বলেন, তার অধিকাংশ গবেষণার উপসংহার মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদে গিয়ে শেষ হতো। এটি একজন প্রকৃত গবেষকের বৈশিষ্ট্য নয়। অর্থনীতি সমিতির মতো একটি প্ল্যাটফর্মকে তিনি ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছেন। অর্থনীতি সমিতি সরকারের অর্থনৈতিকবিষয়ক নীতির সমালোচনা করেছে, বিতর্ক করেছে; কিন্তু কখনো কোনো সরকারের কর্মকাণ্ডকে সত্যায়িত করেনি। অথচ বারকাত দায়িত্বে থাকার সময় এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন। ফলে অর্থনীতি সমিতির অতীতের গৌরব ম্লান হয়ে গেছে এবং সমিতির বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ।