Image description
১.
সাবেক সচিব, ইফার সাবেক ডিজি, লেখক ও দাঈ এ জেড এম শামসুল আলম গত রাত দুইটার দিকে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
এ জেড এম শামসুল আলমের পরিচয় যদি সংক্ষেপে দিতে হয়, তাহলে বলতে হবে : তিনি ছিলেন একজন দাঈ, প্রায় চৌদ্দোশত মানুষ তার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছে। নওমুসলিমদের একটি সংগঠনেরও তিনি প্রধান ছিলেন। তিনি তার সারা জীবনের রুজির বেশিরভাগ অংশ নওমুসলিমদের জন্য ব্যয় করেছেন। তার দ্বিতীয় পরিচয় হচ্ছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সৎ ও দক্ষ আমলার খুব সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হলেও তিনি তার শুরুর দিকে থাকবেন। তার তৃতীয় পরিচয় হলো তিনি একজন পরিশ্রমী লেখক।
২.
তার নামটি কৈশোরকাল থেকে আমার পরিচিত। তবে কোন সূত্রে পরিচিত সেটা মনে নেই। সম্ভবত আমাদের ছোটোবেলায় তিনি ইফার ডিজি ছিলেন বলে, আর তখন আমি ইফা থেকে প্রকাশিত ছোটোদের পত্রিকাটি পড়তাম (এতদিনে পত্রিকাটির নামও ভুলে গেছি)। এর বাইরেও সম্ভবত বিভিন্ন মাসিকে তার লেখা দেখেও অবচেতন মনে নামটি খোদাই হয়ে থাকতে পারে।
অনার্সের শেষ বর্ষ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত আমি কয়েকটি বিক্ষিপ্ত চাকুরি করেছি। এরপর মাস্টার্স শেষ হওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ভাইয়ের সূত্রে বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটির সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রকাশনা ও মার্কেটিং)-এর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পাই। প্রকাশনা সেক্টর যেহেতু আমার আগ্রহের অন্যতম জায়গা ছিল, তাই যথানিয়মে আবেদন করি। লিখিত ও ভাইবার মাধ্যমে নিয়োগ নিশ্চিত হয়। এটাই আমার প্রথম ও শেষ অফিসিয়ালি ফুলটাইম চাকুরি। তখন এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এ জেড এম শামসুল আলম।
আগে থেকে আমার হৃদয়ে সম্মানের আসনে আসীন একজনকে নিজের কর্মক্ষেত্রের প্রধান হিসেবে পেয়ে আমি খুব খুশি হই। অবশ্য অল্প কয়েকদিনের মধ্যে জানতে পারি, শামসুল আলম স্যার মূলত অলংকারিকভাবে প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে আছেন, কিন্তু তিনি কর্মক্ষম নন। আলজেইমারে আক্রান্ত, কিছুই মনে রাখতে পারেন না। উনার সাথে কানেক্টেড প্রত্যেক ব্যক্তির নাম তিনি একটি ডায়েরির সূচিতে লিখে রাখেন এবং তার নামে কয়েকটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ করেন। সাক্ষাৎ হলেই নাম জিজ্ঞেস করে তিনি সূচির সাথে মিলিয়ে নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা খুলেন। তারপর সেটাতে চোখ বুলিয়েই এক চিলতে মুচকি হাসি দেন। আলাপ শুরু করেন পূর্ব আলাপের নোটের সূত্র ধরে।
৩.
তখন শামসুল আলম স্যারের বয়স নব্বই পার হয়ে গেছে। অন্য প্রায় বৃদ্ধের মতো উনারও গল্প বলার লোক নেই। বুক সোসাইটি অফিসে এলে দীর্ঘক্ষণ থাকতেন। অফিস ছুটি হওয়ার পরও অনেক্ষণ থেকে যেতেন এর-ওর সাথে গল্প করে। ঘুরেফিরে একই গল্পগুলো অনেকবার করতেন। স্বাভাবিকভাবেই সেটা পুরোনো এমপ্লয়িদের জন্য বোরিং। তাই সবাই একটু দূরে দূরে থাকতেন। একে তো আমি নতুন, তার ওপর ঢাকায় কোনো সার্কেল নেই, যাওয়ার জায়গা নেই, আবার আগের দিনের গল্পস্বল্পের প্রতি একটা আগ্রহ আছে, সেজন্য আমি উনার সাথে বেশ দীর্ঘ গল্প করতাম। নানান বিষয়ে জানতে চাইতাম। আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে তিনিও তার জীবন-অভিজ্ঞতার ঢালি খুলে দিতেন। সেজন্য শামসু স্যারের জীবনের অনেক গল্পই আমার শোনা হয়েছে। যদিও চাকুরি ছাড়ার প্রায় ৮ বছর হয়ে যাওয়ার কারণে অনেকগুলো ভুলেও গিয়েছি।
৪.
এ জেড এম শামসুল আলম ছিলেন পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশ আমলের প্রায় দীর্ঘ পাঁচ দশক পর্যন্ত খুবই দক্ষ, পরিশ্রমী ও সৎ আমলা। বলা যায় তিনি তার সময়ের নক্ষত্রতুল্য একজন। কিন্তু কোনো রাজনীতি ও ঘরানায় যুক্ত না থাকার কারণে তিনি একাধারে ছিলেন নিঃসঙ্গ। তার এই পেশাগত নিঃসঙ্গতার সাথে যুক্ত হয়েছিল স্ত্রীর মৃত্যু ও দ্বিতীয় বিয়ের কারণে সন্তানদের দূরে সরে যাওয়ার বেদনাও।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর শিক্ষিত সন্তানরা নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় উনাকে সময় দেওয়ার কেউ ছিল না। আবার বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে নিজ উদ্যোগে সবকিছু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তেমনও না। ফলে উনি দ্বিতীয় বিয়েটা করেছিলেন মূলত উনার বাসায় নিযুক্ত সেবিকাকে। ফলে ওই মহিলার সাথেও উনি উনার পর্যায়ের কোনো আলাপ করতে পারতেন না। সব মিলিয়ে একটি বৈরী ও বেদনাদায়ক বার্ধক্য শামসুল আলম স্যারকে কাটাতে হয়েছে। এই বাস্তবতা শুধু উনার না; অনেক শিক্ষিত পরিবারের। এজন্য মাঝে মাঝে ভাবি, সন্তানদের এত বেশি শিক্ষিত করাও উচিত না, যতটুকু শিক্ষিত করলে বৃদ্ধ পিতামাতাকে একা রেখে দূরে চলে যেতে হয় সন্তানদের।
৫.
এ জেড এম শামসুল আলমের শৈশব ও বার্ধক্য দুটোই বেদনার কাল। মাঝখানের প্রায় পাঁচ-ছয় দশক দক্ষতা, সাফল্য, পরিশ্রম ও অর্জনের গল্প। তার জন্ম ও পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লার চান্দিনায়। একেবারে ছোটোকালে মা মারা গেছেন। ছয়-সাত বছর বয়সে তার পিতা খুন হন জায়গা-জমি সংক্রান্ত পারিবারিক দাঙ্গায়। তারপর নানুর বাড়ি, ফুফুর বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় দুলতে দুলতে তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছান। খুব ভালো রেজাল্ট করে শিক্ষাজীবন শেষ করেন।
ঢাকা কলেজের লেকচারার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। এর পরে প্রথমশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা সিএসপি (বর্তমান বিসিএস) হয়েছেন। তিনি কুমিল্লার অবিভক্ত চান্দিনা উপজেলার প্রথম সিএসপি। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে অবিভক্ত পাকিস্তানে প্রথম বা দ্বিতীয় হন (স্মৃতি থেকে লেখার কারণে বিভ্রম আছে)। দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততাকে পুঁজি করে সারা দেশে আলোচিত আমলা হয়ে উঠেন তিনি। পরে সচিব হয়েছেন। ইফার ডিজি ছিলেন। আল আরাফাহ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানও তিনি।
পেশার পাশাপাশি ইসলামের প্রতিও ছিল তার দুর্নিবার আকর্ষণ ও নিরবচ্ছিন্ন নিষ্ঠা। তিনি একেবারে জীবনের প্রারম্ভিক সময় থেকেই নামাজি ও পরহেজগার ছিলেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়তেন এবং লিখতেন। কিন্তু আমাদের দেশে সাধারণত যা হয়, কোনো না কোনো ঘরানায় থেকে দ্বীন চর্চা, তিনি সেটাতে যাননি। সবার সাথেই মিশতেন, সবার সাথেই সুসম্পর্ক রাখতেন, কিন্তু কারও ঘরানায় আবদ্ধ হয়ে যাননি।
তাবলিগের ওপর তিনি কাজ করেছেন। বিশাল কাজ। হাজার পৃষ্ঠার ওপরে সেই কাজের পরিধি। আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে তিনিই প্রথম কওমী মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকজনকে এনে চাকুরি দিয়েছেন প্রচুর পরিমাণে; কেননা, তারা সাধারণত চাকুরির বাজারে বঞ্চিত। তাও এখন থেকে অন্তত দুই দশক আগে, যখন কওমিরা এখনকার তুলনায় আরও অনেক বেশি পিছিয়ে ছিল। প্রচুর নওমুসলিমকে চাকুরি দিয়েছেন। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেক নওমুসলিমের কর্মসংস্থানের চেষ্টা করেছেন। তার কাছে আগত কোনো নওমুসলিমকে তিনি ফেরাতে চাননি।
জামায়াতের সাথেও ছিল তার সুসম্পর্ক। তার সততা ও বিশ্বস্ততার ওপর জামায়াতের আস্থা ছিল। তাই চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জামায়াতের মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ থাকা ইফার ডিজি হিসেবে তাকেই পছন্দ করা হয়। যদিও এই পদটি তার সিনিয়রিটির তুলনায় ছিল ছোটো। তারপরও তিনি এ জায়গায় ইসলামের জন্য কাজ করার সুযোগ বেশি ধরে নিয়ে এখানে আসেন খুশিমনে। এমনকি প্রথম মেয়াদে দায়িত্বপালন শেষে তাকে যখন আরও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রমোশন দেওয়া হয়, তখন তিনি সেই প্রমোশন গ্রহণ না করে ইফাতে দ্বিতীয় মেয়াদে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সরকার সম্মতি দিলে তিনি এখানেই দায়িত্ব পালন করেন।
সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তাকে জামায়াত তাদের ঘরানার একটি বড়ো প্রতিষ্ঠানে আমৃত্যু চেয়ারম্যান হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। এটা তার ওপর জামায়াতের আস্থা ও সুসম্পর্কের বড়ো উদাহরণ।
৬.
ইসলামঘনিষ্ঠ ও পেশাগত নিষ্ঠার জায়গা থেকে তিনি একাত্তরের পুরো সময়টা স্বপদে দায়িত্বপালন করেছেন। তিনি কোনো রাজনীতি ও ঘরানার সাথে উতপ্রোতভাবে জড়িত না থাকার কারণে একাত্তরে কোনো পক্ষের প্রতিই তার অবস্থান ছিল না। তিনি যথানিয়মে অফিস করেছেন, কাজ করেছেন এবং ঢাকায় ছিলেন। একাত্তরে সরকারের প্রতি অসহযোগিতার যে আহ্বান শেখ মুজিব জানিয়েছিলেন, তাতে সাড়া না দিয়ে স্বপদে বহাল থাকায় তিনি স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে মুজিব সরকারের রোষানলে পড়েন। এমনকি বিদেশ পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
বিদেশে রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। তার প্রধান কাজ ছিল ডিশ ওয়াশিং বা এই জাতীয়। দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা থেকে গিয়ে সেই কাজও তিনি যথাযথভাবে করেছেন। এবং মালিকের সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হলে পূর্ববর্তী দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাদের তালিকা করা হয়, যাদেরকে মুজিব সরকার অন্যায়ভাবে বাদ দিয়েছিল। সেই তালিকার শীর্ষস্থানীয় একজন হিসেবে এ জেড এম শামসুল আলম ডাক পান সচিবালয়ে যোগদানের। অবশেষে তিনি দেশে ফিরে এসে সচিব হিসেবে কাজ শুরু করেন।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রকল্পে তিনি দক্ষতা ও সততার সাথে কাজ করেন। যতটুকু জানি, তিনি যমুনা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রধান নির্বাহী ছিলেন।
৭.
এ জেড এম শামসুল আলম অনেক লিখেছেন। তার লেখার প্রধান বিষয় ছিল দুটি : ১. ইসলাম ২. পেশাগত উৎকর্ষ। ‘ব্যক্তিত্বের বিকাশ’ সম্ভবত তার শ্রেষ্ঠ রচনা। ছোটোদের জন্যও লিখেছেন হাত খুলে। কিন্তু লেখক হিসেবে তিনি তার প্রাপ্য রয়্যালিটি ও অন্যান্য সম্মানি পাননি। বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি ছাড়া আর কোনো প্রকাশকই তার সাথে পেশাদার আচরণ করেনি। বাংলাবাজারের অনেক প্রকাশক তার বই ছাপিয়ে সরকারি টেন্ডার ইত্যাদি সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে, কিন্তু তাকে তার প্রাপ্য দেয়নি। এমনকি তিনি শেষ জীবনে সবগুলো বই বুক সোসাইটিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেও সফল হননি। কারণ, বাংলাবাজারি পাবলিশাররা একাধিকবার চেষ্টা করার পরও তার সাথে এই বিষয়ে আলাপ করতে আসেনি। অনুমতি ছাড়াই তারা বছরের পর বছর তার বই ছাপিয়ে গিয়েছে।
৮.
আমি জামায়াত করি, এটা জানার পর তিনি একটি গল্প বেশ কয়েকবার করেছিলেন। আশির দশকে তিনি অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। তিনি পরামর্শ চান জামায়াতে যোগদানের বিষয়ে। গোলাম আযম রাহি. তাকে বলেন, আপনি জামায়াতে যোগ না দিয়েই ইসলামের জন্য অনেক কাজ করছেন। সেটাই অব্যাহত রাখুন।
৯.
এ জেড এম শামসুল আলম ছিলেন সিগ্ধ রুচির মানুষ। বৃদ্ধকালে এমনকি অনেকটা পরিবার-পরিজন বিচ্ছিন্ন অবস্থায়ও তার পোশাক থাকত পরিপাটি। আমি বুক সোসাইটিতে থাকাকালীন বিয়ে করি। আমার বিয়ের খবর জানার পর তিনি আমাকে তার জীবনের বৈবাহিক জীবনের গল্প বলেছিলেন। তার একটি অংশ এমন :
আমার বেগম ছিলেন তখনকার সময়ের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী। চিন্তা করতে পারো তুমি? পাকিস্তান আমলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ত সে। প্রথম সাক্ষাতেই আমি তাকে বলি, ‘তুমি তো ইংরেজি বলতে পারো নিশ্চয়। আমারও ইংরেজি চর্চার খুব শখ। কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলার লোক পাই না। তুমি আর আমি ইংরেজিতেই কথা বলব সবসময়। কী বলো?’ পরে আমরা প্রায়ই ইংরেজিতে কথা বলেছি।
আমার বেগম বোরকা পরত। কিন্তু আমি তাকে শর্ত দিলাম : ‘তুমি কালো বোরকা পড়তে পারবা না। কালো রঙ আমার পছন্দ না। অন্য যেকোনো রঙের বোরকা তুমি পছন্দ করতে পারো। আমি বানিয়ে দেবো।’ তখনকার সময়ে কালো আর সাদা বোরকা ছাড়া কোনো বোরকা ছিল না। কিন্তু আমরা বেগম কালারফুল বোরকা পরত, আমার আগ্রহেই। হা হা হা।
১০.
এ জেড এম শামসুল আলম স্যার আমাকে অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে। সেগুলোর কিছু আমি তখনই নোট করেছিলাম। সেখান থেকে কিছু এখানে তুলে দিচ্ছি :
*সাতচল্লিশে দেশভাগের পরপর আমি ঢাকা কলেজে পড়তে আসি, কিন্তু ঢাকা শহরের যে অবস্থা তাতে হতভম্ব হয়ে গেলাম। একটি বাস অনুপযোগী নোংরা শহর! অবশ্য শহর বলার মতোও কিছু না। ঢাকা কলেজ বেড়ার, টিনের ছাউনি। দরজা-জানালা ছিল না। দিনে গরু-ছাগল ঢুকত, রাতে ঘুমাত কুকুর! বেহাল এ অবস্থা দেখে কুমিল্লা চলে গেলাম, কুমিল্লা তখন ঢাকার চেয়ে ঢের ভালো শহর! কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে আবার ঢাকায় এসে দেখলাম ঢাকা পুরাই পালটে গেছে। চারদিকে একটি সাজ সাজ রব, পরিবর্তনের ছোঁয়া সবখানে! সাতচল্লিশের দেশভাগ ঢাকার ভাগ্য গড়ে দিয়েছে।
*ঢাকা কলেজের লেকচারার পদ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম লেকচারার হিসেবে। রাবির শিক্ষকরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করলেন : ‘আপনি কী বুঝে ঢাকা কলেজ ছেড়ে রাজশাহী এলেন?’
আশ্চর্যান্বিত হয়ে জানতে চাইলাম : ‘কেন? কী হলো?’
‘আ রে! আমাদের এখানে তো কোনো ছাত্রই নাই এখনও!’
সেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আজকে দেখো একটি বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়। জেনে রেখ, সবকিছুই শুন্য থেকে শুরু হয়।
*অন্যান্য উম্মতের তুলনায় সংক্ষিপ্ত হায়াতের কারণে আমাদের সওয়াব কামাইয়ের সুযোগ কম। তাই কম পুঁজিতে বেশি রুজির পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। আর তা হলো সবসময় পবিত্র থাকা, অজুর সাথে থাকা, সবকাজ বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা এবং শেষ করে আলহামদুলিল্লাহ বলা। অফিসে এসে ফাইল খুলবা বিসমিল্লাহ বলে, সাইন করার পর আলহামদুলিল্লাহ বলবা। আমি এইটা করতাম। এমনকি স্ত্রীর কাছে যাওয়ার সময়ও।
*সব কাজকে ইবাদত হিসেবে নিবা। চাকুরিকেও। নিয়ত খালেস রাখবা। সব জায়েজ কাজ খালেস নিয়তে করলে ইবাদত গণ্য হবে।
*ষাট বছর বয়স পার করার পর আমি একদিন চিন্তা করলাম, আচ্ছা সর্বপ্রথম ফরজ হয়েছিল কোন কাজ? উত্তর পেলাম, দাওয়াত। রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রতি প্রথম নির্দেশ ছিল দাওয়াতের এবং তিনি অমুসলিমদের প্রতিই প্রথম ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন।
এটা বুঝে আসার পর থেকে আমিও এটা করার চেষ্টা করলাম। এ পর্যন্ত আমার চেষ্টায় প্রায় চৌদ্দশো মানুষ ইসলামে এসেছে, আলহামদুলিল্লাহ। আমি আমার সকল সঞ্চয় এ কাজের জন্য কুরবানি করেছি, সন্তানদের তেমন কিছু দিতে পারিনি। এ কথা কাউকে বলিনি, তোমাকে বললাম উৎসাহিত করার জন্য। যেখানেই যাও, সুযোগ পেলেই দাওয়াত দিবা ইসলামের দিকে।
*কাজকে নিবা মনোযোগের সাথে। তাহলে সঠিক পথ পাবা, এমনকিও স্বপ্নেও নির্দেশনা পেয়ে যেতে পারো। আমি যে কাজ নিয়া পেরেশানিতে পড়ে যেতাম, সে বিষয়ে প্রায়সময় স্বপ্নে নির্দেশনা পেতাম।
*যখন যে পরিকল্পনা ও আইডিয়া মাথায় আসবে সাথে সাথে লিখে রাখবা; স্মৃতিকে বেশি বিশ্বাস করবা না।
১১.
আবু যার গিফারি রা.-এর প্রতি এ জেড এম শামসুল আলম স্যারের বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি প্রায়ই আবু যার রা.-এর গল্প করতেন। তার একটি বইও আছে আবু যারের ওপর। শামসুল আলম স্যার তার প্রিয় সাহাবি আবু যার রা.-এর মতোই ছিলেন নিঃসঙ্গ। বিদায়ও নিলেন অনেকটা নিঃসঙ্গতার সাথে। ঘরানাহীন, বন্ধুহীন, পরিজনহীন এক নিঃসঙ্গ নক্ষত্র হয়ে তিনি আজ দুনিয়ার সফর শেষ করেছেন। এক নীরব দাঈর বিদায় হলো।