
বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতাসহ ছয় ঝুঁকি এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে দ্রুত গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্য সব ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে-ভারতের গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার শস্যচুক্তি নবায়ন না হওয়া, রাশিয়া ও ইউক্রেন এবং ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ, রেড সি কনফ্লিক্টের কারণে বিশ্বব্যাপী গমের মূল্য বৃদ্ধির শঙ্কা এবং সরবরাহের অনিশ্চয়তা।
উল্লিখিত ঝুঁকিগুলোর ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করে খাদ্য অধিদপ্তর বলেছে ‘খাদ্য সরবরাহ পদ্ধতি বা পাবলিক ফুট ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম সচল রাখতে গম আমদানি অব্যাহত রাখা জরুরি। বিশেষ করে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এবং ওএমএসের মাধ্যমে সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণ, একক উৎস থেকে আমদানির ঝুঁকি মোকাবিলায় একাধিক সোর্স বৃদ্ধি এবং আমদানির পথ উন্মুক্ত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমুদ্রপথে গম কেনা যেতে পারে।
এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের কমিটি সারসংক্ষেপ নোটে। বুধবার ওই কমিটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। তবে ওই দেশ থেকে আগামীতে আরও তিন লাখ ৩০ হাজার টন আমদানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির সিদ্ধান্তের আগে ৫০ হাজার টন গম অন্য একটি দেশ থেকে আনার ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। যা প্রক্রিয়াধীন আছে। চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) আন্তর্জাতিক উৎস থেকে সরকারিভাবে ৬ লাখ টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ আছে।
এ প্রসঙ্গে ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভাপতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির যুক্তি হচ্ছে, আমরা একটু ভিন্নতা আনতে চাচ্ছি। রাশিয়ান ব্লক কিংবা ইউক্রেন ব্লকে অনিশ্চয়তা দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখন আমাদের আমদানি বাড়ানোর আলোচনা চলছে। সেখানের উৎপাদিত গমের মান ভালো। দাম তুলনামূলক বেশি হলেও গমে প্রোটিনও কিছুটা বেশি আছে।
এদিকে উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকের সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়, এগ্রোক্রপ ইন্টারন্যাশনাল প্রা. লি.র মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম কেনা হবে। সরবরাহকৃত এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গম কিনতে প্রতি টনের মূল্য পড়বে ৩০২.৭৫ মার্কিন ডলার। প্রতি মার্কিন ডলার ১২২.৭৫ টাকা হিসাবে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানিতে মোট ব্যয় হবে ৮১৭ কোটি ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার ৭৫০ টাকা।
অপরদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের গঠিত বাজার দর যাচাই কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমুদ্রপথে বার্থ অপারেটিং হ্যান্ডলিং, লাইটারিং ও বিমা ব্যয়, মুনাফা ও অন্যান্য খরচসহ বাংলাদেশ বন্দর পর্যন্ত থেকে প্রতি টন গমের শুদ্ধ পূর্ব মূল্য হবে ৩০২.৬২ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে এফওবি মূল্য ২৩৫ ডলার, সম্ভাব্য জাহাজ ভাড়া ৫৫, বিমা ব্যয় ২.৯০, মুনাফা ৪.১৫, অন্যান্য ব্যয় ৫.৫৭। সরকার এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান উভয়ের মূল্য ব্যবধান প্রতি টনে ০.১৩ মা. ডলার। অর্থাৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মূল্য বেশি। আমদানি ব্যয় বিশ্লেষণ করে সারসংক্ষেপে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের মূল্য কম আছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও জনস্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই গম সংগ্রহ করা যেতে পারে। মোট গমের পরিমাণের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৬০ শতাংশ এবং বাকি ৪০ শতাংশ খালাস হবে মোংলা বন্দর হয়ে।
এদিকে ৩০ জুন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির ব্যাপারে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান একটি আধা-সরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছেন খাদ্য সচিবকে। সেখানে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বিদ্যমান ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে আরও ৩৭ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অধিক পণ্য আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম ও অন্যান্য কৃষিপণ্য আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব।
তিনি আরও বলেছেন, এই পদক্ষেপে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা হবে এবং প্রস্তাবিত শুল্ক কমাতে আলোচনায় বা দরকষাকষি করতে সহায়ক হতে পারে। সরকারি খাতে গম এবং অন্যান্য খাদ্যশস্য আমদানি করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ৬ বিলিয়ন বাণিজ্য ঘাটতি কমতে ভূমিকা রাখতে পারে।
৭ জুলাই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ঘোষণা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। যা পহেলা আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। পালটা শুল্কের হার কমানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি পেতে বাংলাদেশ গম আমদানি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেগুলোর ওপর শুল্ক প্রায় শতভাগ প্রত্যাহারের পক্ষেও সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন, তেলবীজ, ডাল, চিনি ও বার্লি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অন্যান্য আমদানির মধ্যে থাকছে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ, এলএনজি, সামরিক সরঞ্জাম। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চলতি বাজেটে ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সূত্রমতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রথমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে থেকে পত্র দেওয়া হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটস গম সরবরাহে সহায়তা করতে আগ্রহ দেখিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। এরপর সে চিঠি পর্যালোচনার পর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটসের প্রতিনিধিদলকে ভার্চুয়াল সভায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সে প্রেক্ষিতে সংস্থাটির সঙ্গে ২৬ জুন এবং ৩ জুলাই দুদফা ভার্চুয়াল নেগোসিয়েশন বৈঠক হয়। সেখানে গম আমদানির চুক্তির শর্ত এবং মূল্য নিয়ে বিশদ আলোচনা ও নেগোসিয়েশন হয়। সে হিসাবে প্রতি টন ৩০২.৭৫ মা. ডলার ঠিক করা হয়। এলসি খোলার পর ৯০ দিনের মধ্যে এই সরবরাহ করা হবে।
এদিকে গম কেনা প্রতিষ্ঠান ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটস প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি সংস্থা বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, উক্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গম শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সরকারি/অফিশিয়াল রপ্তানি বাজার উন্নয়ন সংস্থা এবং ইউএসডিএর সহযোগী অংশীদার। মি. জোসেপ কে সোয়ার্র হলেন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং এ অঞ্চলে কার্যক্রম তদারকি করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে হুইট অ্যাসোসিয়েটস বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশের গম ক্রেতা, মিলার, ব্রোকার্স, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে সব শ্রেণির গমের নির্ভরযোগ্যতা, গুণগত মান ও মূল্য তুলে ধরে। ইউএসডিএ সহযোগী অংশীদার হিসাবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বাণিজ্য সহযোগিতার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থায় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান।