
গ্রেফতার হওয়া সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। প্রধান বিচারপতির শীর্ষ পদে থেকে তিনি কাজ করেছেন ফ্যাসিস্ট হাসিনার দলদাস হয়ে। গণতন্ত্র হত্যা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেছেন। ফলে বিনা ভোটে হাসিনা দেশকে শাসন ও মানুষকে শোষণ করতে পেরেছেন টানা দেড় দশক। বিভীষিকাময় এই সময়টিতে মানুষ শুধু ভোটের অধিকারই হারায়নি। মানুষ হারিয়েছে কথা বলার স্বাধীনতা। কেড়ে নেয়া হয়েছে মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার। কথা বললেই শুরু হতো দমন-পীড়ন। হত্যা, খুন, গুম। ‘জঙ্গি’ তকমা দিয়ে জ্বলজ্যান্ত মানুষকে ঘরে আটকে রেখে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া। রাজনৈতিক দলগুলো হারিয়েছিল রাজনীতি করার অধিকার। নেতাকর্মীরা লাখ লাখ মিথ্যা মামলার আসামি হয়েছেন। কোনো অপরাধ না করলেও করতে হয়েছে কারাবরণ। টিকতে না পেরে দেশান্তরি হয়েছেন বহু মানুষ। হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের গুরুত্বপূর্ণ আর্কিটেক্ট ছিলেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
‘প্রধান বিচারপতি’ একটি শীর্ষস্থানীয় ও সাংবিধানিক পদ। এ পদে যাকে বসানো হয় তাকে নিরপেক্ষতার জন্য শপথ নিতে হয়। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। বিচারকের আসনে বসে তিনি রাজনীতি করেছেন। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের উনুনে খড়ির জোগান দিয়েছেন। তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। শপথ ভঙ্গেরও অবশ্য শাস্তি আছে। এ বি এম খায়রুল হক শুধু নিছক ‘শপথ ভঙ্গ’ করেননি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে তিনি হাসিনার হয়ে রাজনীতি করেছেন। রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে ‘বিচার’-এর আওতায় এনে অবিচার করেছেন। আর এ অবিচারের ভুক্তভোগী গোটা জাতি। তার কারণে অনেক প্রাণ ঝরেছে। ক্রয় ফায়ারের শিকার হয়েছেন। গুম হয়েছেন। বহু মিথ্যা ও গায়েবি মামলার আসামি হয়েছেন। অনেকের ব্যক্তি জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সেই মানুষগুলোর সঙ্গে হাসিনা-খায়রুল হকদের সরকার যে আচরণ করেছে তাতে খায়রুল হকের বহুবার ফাঁসি হওয়া উচিত। কারণ তার পেশাগত শঠতা, অনৈতিকতা, মিথ্যাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, দ্বিচারিতা, চাতুর্য, প্রতারণা, আত্মসাৎ, রাজনীতিকায়নÑ প্রতিটিই ফৌজদারি অপরাধ। তার শঠতার কারণে জাতীয় জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় অধ্যায়। তার কারণেই সংঘটিত হয় জুলাই-আগস্ট বিপ্লব। আজকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ভিত্তি ভূমি নির্মাণ করেন এ বি এম খায়রুল হক। তার প্রতি শুধু ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর নয়Ñ পুরো জাতির রয়েছে তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কারের থুথু। এ ঘৃণা থেকেই তার পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য কোনো আইনজীবীও দাঁড়াচ্ছেন না। বিচারে তার মৃত্যুদ- হলেও জাতি স্বস্তি পাবে।
খায়রুল হকের অপরাধ এবং বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি বিবেচনায় তাকে গ্রেফতার, বিচার সাপেক্ষে শাস্তি নিশ্চিতের দায় এই সরকারের সবচেয়ে বেশি। যদিও তার বিলম্ব গ্রেফতারকে ‘হাসিনা সরকারের অনুকরণ’ বলে সমালোচনা করছেন কেউ কেউ। মানুষের মনোযোগ ঘোরাতে হাসিনা চট করে এমন একেকটি ইস্যু মার্কেটে ছেড়ে দিতেন। মানুষ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত সেটি নিয়ে। এবারো তাই হলো। মাইলস্টোন কলেজের মর্মান্তিক প্লেন ক্রাশের ঘটনায় জাতি যখন শোকে মুহ্যমান। ঠিক তখনই (২৪ জুলাই) শোকবিহ্বল মানুষের সামনে হাজির করা হয় হাতকড়া-হেলমেট পরা এ বি এম খায়রুল হককে। মানুষ এ জন্য সরকারকে কোনো ধন্যবাদ দেয়নি; বরং প্রশ্ন তুলছেÑ এত দিন কেন তাকে গ্রেফতার করা হলো না? নাকি ইচ্ছে করেই তাকে গ্রেফতার করা হয়নি? হতে পারে এর কোনো একটি।
বাস্তবতা হচ্ছেÑ হাসিনার ফ্যাসিজমের বিচার বিভাগীয় সহযোগী এ বি এম খায়রুল হককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি এখন কারাগারে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান চলাকালে যাত্রাবাড়ীতে নিহত হন আব্দুল কাইয়ুম। এ মামলায় খায়রুল হককে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে আরো তিনটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় ঘৃণ্য খায়রুল হককে কতটা ‘দোষী সাব্যস্ত’ করা সম্ভব সেটি তদন্ত প্রতিবেদন বলে দেবে। তবে এ বি এম খায়রুল হকের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করাটা জরুরি। ভবিষ্যতে আর কোনো খায়রুল হকের যাতে পয়দা না হয়, সেটি দৃষ্টান্ত হিসেবেই এ বিচারপতির বিচার হওয়া খুব প্রয়োজন।
প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে নিশ্চিত হবে সেটি? ‘বিচার’-এর নামে এ বি এম খায়রুল হকের অবিচারগুলো মোটা দাগের। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন তিনি। তার টিমে ছিলেন বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এ বি এম খায়রুল হককে গ্রেফতার করা হলেও তার অ্যাসোসিয়েটসদের গায়ে অদ্যাবধি কোনো আঁচড় পড়েনি। এই চতুষ্টয়ের অবিচারমূলক রায়ের কারণে বদলে যায় জাতীয় জীবনের গতিধারা। ধ্বংস হয় নির্বাচন ব্যবস্থা। মৃত্যু হয় গণতন্ত্রের। কিন্তু বিচারিক অপরাধের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সীমাহীন ক্ষতির বিচারে কোনো আইন আছে কি?
এ বি এম খায়রুল হক হাসিনার ইঙ্গিতে বেশ কিছু রাজনৈতিক বিষয়কে ‘বিচার’-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বিশেষ করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নয়, শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ এমন রায় দেন। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খ- বাতিল ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে খ-টির দেশ-বিদেশের সব স্থান থেকে বাজেয়াপ্ত ও প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন খায়রুল হক। রায়ে তিনি বলেছিলেন, যারা এরকম ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে জড়িত, তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। এ ধরনের রায় দেয়ার কারণে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানও নেই।
কোনো ধরনের শুনানি ছাড়া বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার রায়টি এ বি এম খায়রুল হকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায়। কিন্তু কোনো বিচারক এমন রায় দিলে সেটি ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’-এমন আইনও বর্তমান নেই। সর্বোপরি যেসব হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে, সেগুলোও তদন্ত ও প্রমাণসাপেক্ষ। ফলে এসব মামলা থেকে এ বি এম খায়রুল হককে শাস্তি দেয়ার মতো উপাদান বের করার বিষয়ে সন্দিগ্ধ বিচারাঙ্গনের মানুষ। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের রাজনীতি বদলে দেয়া এ ঘৃণ্য বিচারপতির কি তাহলে কোনো শাস্তিই হবে না? এ প্রশ্নে দু’ধরনের কথা বলছেন আইন ও বিচার বিশ্লেষকরা।
তবে ভিন্নমত পোষণ করেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ। তিনি বলেন, এ বি এম খায়রুল হক শপথ ভঙ্গের মতো গুরুতর অপরাধ করেছেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ বি এম খায়রুল হক শপথ নিয়েছিলেন। অবসর গ্রহণের পর তার কোনো শপথ ছিল না। অথচ তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত রায়ে (পঞ্চদশ সংশোধনী) স্বাক্ষর করেছেন অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর। এটি একটি অপরাধ। দ্বিতীয়ত, তিনি পঞ্চদশ সংশোধনীর রায়ে ওপেন কোর্টে দিলেন শর্ট অর্ডার। যাতে পরবর্তী আরো দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার কথা বলেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি সেটি পরিবর্তন করে ফেলেন। বিধান হচ্ছেÑ সংক্ষিপ্ত রায় এবং বিস্তারিত রায় হতে হবে ওপেন কোর্টে। রায় স্বাক্ষরও হতে হবে ওপেন কোর্টে। রায় বদলে দিয়ে তিনি গুরুতর অপরাধ করেছেন। এ ধরনের বিচারিক অপরাধের সরাসরি কোনো শাস্তি নির্ধারণ করা নেই। তবে সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা যায়। এ অনুচ্ছেদে সাংবিধানিক পদগুলোতে শপথ নেয়ার কথা রয়েছে। বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, তৃতীয় তফসিলে উল্লিখিত যেকোনো পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যভার গ্রহণের পূর্বে নির্ধারণ শপথ গ্রহণ করবেন এবং শপথপত্রে স্বাক্ষর করবেন। এই শপথের উদ্দেশ্য হলোÑ সংবিধান ও দেশের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা এবং কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করা। সংবিধানে ‘শপথ ভঙ্গের শাস্তি’র কথা সরাসরি উল্লেখ নেই। তবে সংবিধানের প্রতি অঙ্গীকার ভঙ্গ করাকে ‘গুরুতর অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হতে পারে। যদি কেউ শপথ ভঙ্গের মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘন করে, তাহলে তাকে সংবিধানের অন্যান্য বিধান এবং প্রচলিত আইনের অধীনে বিচার ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এটি রাষ্ট্রদ্র্রোহিতা বা অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকা-ের আওতায় আসতে পারে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘অনুচ্ছেদ নম্বর ৭ক’ অন্তর্ভুক্ত করে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়-এ সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে, কিংবা এ সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে তার এ কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে। অনুচ্ছেদটিতে আরো বলা হয়Ñ এরূপ কার্যের সহযোগী বা উসকানিদাতা সমঅপরাধে অপরাধী হবে এবং এরূপ অপরাধের সাজা প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দ-ে মধ্যে সর্বোচ্চ দ- (মৃত্যুদ-)।
ইকতেদার আহমেদ বলেন, শপথ না থাকা অবস্থায় রায় দেয়ার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদ-। এ বি এম খায়রুল হক মৃত্যুদ-ের অপরাধ করেছেন। সংক্ষিপ্ত রায় ও মূল রায়ের পার্থক্য। এটিও রাষ্ট্রদ্রোহিতা। বিভিন্ন রায়ে খায়রুল হক ফ্রড করেছেন। আগামী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। সংক্ষিপ্ত রায়ে এমন কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ে সেটি নেই। তিনি বলেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, শুধু এ বি এম খায়রুল হক নন; তৎকালীন তার বেঞ্চে থাকা অপর তিন বিচারপতিও রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। বিচারপতি খায়রুল হক নেতৃত্বাধীন ওই বেঞ্চে বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ছিলেন। ওই রায়ে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, এসকে সিনহাও সম্পৃক্ত ছিলেন।
সংবিধান লঙ্ঘন এবং শপথ ভঙ্গের দায়ে এ পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। ৭-এর ক ধারায় এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। যেকোনো সংক্ষুব্ধ নাগরিক এ মামলা করতে পারেন। যোগ করেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ।