
ধরে নিচ্ছি নির্বাচন হবে। তবে কবে হবে, সে বিষয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে না। ধরে নিচ্ছি, খুব শিগগির নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হবে, কিন্তু অরাজকতা সৃষ্টি করে তা বানচালের চেষ্টা হবে না, এ রকম নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। সবটা মিলে যে ভজকট পাকিয়ে ফেলা হয়েছে, তাতে সাধারণ জনগণ কোনো সুখস্বপ্ন দেখার অবস্থায় নেই। তারপরও একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশা তো থেকেই যায়। আশা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই প্রবল প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আশার সন্ধান চায় জনগণ।
আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি নির্বাচন নিয়ে প্রহসন করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার এসেছিল সবার অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার সংকল্প নিয়ে। মেটিকুলাস বলা হোক আর স্বতঃস্ফূর্ত বলা হোক, আওয়ামী লীগ সরকার যে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেই ক্ষমতা হারাবে, সেটা আন্দোলনকারীরাও ভাবেনি। সেটা বিভিন্ন সময় তাদের বলা কথা থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। ফলে, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে খুব দ্রুত মতভেদ তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, সংক্ষিপ্ত অথচ প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরপরই নির্বাচন দিয়ে দেওয়া ভালো। পরবর্তী সংস্কার করবেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যে বাঘের পিঠে উঠেছে, সেখান থেকে নামার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, যত দিন জনগণ তাঁদের চাইবে, তত দিন তাঁরা ক্ষমতায় থাকবেন। জনগণের মনের ভাষা পড়ার ইচ্ছে বা অভিপ্রায় এই সরকারের আছে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন আছে।
২.
নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে সেই নির্বাচনের দিনই জনগণ তাদের হাতে ক্ষমতা পায়। ওই এক দিনই। আমাদের দেশে যেন এখন পর্যন্ত সেটাই নিয়ম হয়ে আছে। এরপর নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেয় সব। গণতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষাকারী আইন পরিষদ, আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ইত্যাদি যদি সক্রিয় থাকে, স্বাধীনভাবে কাজ করে চলে, সবার যদি জবাবদিহি করার জায়গা থাকে, সমালোচনাকে যদি পরামর্শ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে সে দেশে গণতন্ত্র পোক্ত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ‘উইনার টেকস অল’ কথাটার মর্মার্থকে আমল না দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সবকিছু করায়ত্ত করে নেয় বিজয়ীরা। তাদের ক্ষমতাবলয়ে এসে ঘুরপাক খেতে থাকে সবকিছু। ফলে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম হতে সময় নেয় না। যে যত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকে, সে তত বড় স্বৈরাচার হয়ে ওঠে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগকে যে অবস্থায় দেখেছে, সেই অবস্থাটা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও তৈরি করেছিল। সেটা তাদের জানা নেই। তাই সংস্কারের বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া খুবই জরুরি, কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেটা কবে কখন করা হবে। নির্বাচনের আগে না পরে? আগে হলে এই বছরখানেক সময়ে কেন কিছুই হলো না, সে প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?
ভোটের দিনই কি জনগণের ক্ষমতা দেখানোর একটিমাত্র দিন হিসেবে স্বীকৃত হবে? বরাবর যা হয়? নাকি কোনো পরিবর্তন আসবে? কাদের হাত ধরে পরিবর্তন আসবে? কাউকে কি দেখা যাচ্ছে, যার ওপর আস্থা রাখা যায়?
৩.
ধরে নিচ্ছি নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে অতীতে যা ঘটে গেছে, তা নিয়ে কয়েকটি কথা বলে রাখলে তরুণ প্রজন্ম দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিতে পারবে।
১৯৮২ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আইয়ুব খানের মতোই ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। ১৯৮৩ সালেই তাঁর বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলনে নেমে পড়েছিল। শিক্ষা ভবনের সামনে সেদিন অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন জাফর, জয়নাল, তিতাস, দীপালিরা। শহীদের এই তালিকা দিনে দিনে বেড়েছিল। সেলিম-দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়া, নূর হোসেন, ডা. মিলন—কয়েকটি নাম শুধু। কিন্তু এরশাদকে হটিয়ে দিতে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল দেশজুড়ে, তা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। একসময় এরশাদের ক্ষমতার গদি টলমল হয়ে পড়ে এবং তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
পটভূমিটি বলা হলো এই কারণে যে, এরপর ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন শাসনের আগপর্যন্ত তিনটি গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকার দেখেছে জনগণ। তখন রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, জনগণ ভোট দেওয়ার সময় কোন দিকগুলো মনে রাখে।
এরশাদের পতনের পর যে আবহ তৈরি হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল আওয়ামী লীগ এবার বহুদিন পর ক্ষমতায় আসবে। আওয়ামী লীগও তা ভেবেছিল। আর তাই ক্ষমতায় আসার আগেই নির্বাচনী প্রচারণার সময় দলটির নেতারা যে ভাষায় কথা বলছিলেন, তাতে আতঙ্কিত হয়ে উঠছিল জনগণ। সাংবাদিক মাহবুব কামালের একটি লেখায় সে সময়ের নির্বাচনগুলো নিয়ে একটা পর্যবেক্ষণ আছে, তার কিছুটা এখানে ব্যবহার করা হবে। খুলনার একটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন শেখ আবদুল আজিজ। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে দুইটা শেখ, শেখ মুজিব ও শেখ আবদুল আজিজ। ওই রাজাকারের বাচ্চা (জামায়াতের প্রার্থীর দিকে ইঙ্গিত করে) আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর রূপসা নদীতে ওর লাশ ভাসবে।’ এই ভাষণের পর জামায়াত প্রার্থী দ্বারে দ্বারে গিয়ে বলেছেন, ভাই, একটা ভোট দিয়ে আমাকে বাঁচান। বলা বাহুল্য, সেই আসনে জামায়াত প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের কর্মীরা নাকি কেউ ২০০০ টাকা চাঁদা দিলে তা ফিরিয়ে দিয়ে বলত, ‘দুই হাজার টাকা চাঁদা নেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ করি না।’ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর শেষ নির্বাচনী ভাষণে ‘অখ্যাত মেজর’ শব্দটি ব্যবহার করেও ভোটারদের মনে সংশয় সৃষ্টি করেছিলেন। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো, বিএনপি জিতে গেল নির্বাচনে।
কিন্তু ১৯৯৬ সালে দেখা গেল ভিন্ন অবস্থা। মানুষ তত দিনে বিএনপির শাসন দেখে ফেলেছে। বিএনপি দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে আয়ত্তে রাখতে পারেনি। সারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের হত্যা করেছে পুলিশ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলতেন, এটা না খেলে কী হয়, ওটা না খেলে কী হয়। অনেকেই যে কাঁঠাল খাওয়া নিয়ে শেখ হাসিনাকে বিদ্রূপ করে থাকেন, তার শুরুটা কিন্তু সাইফুর রহমান করে গেছেন। আর এ সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকাতে আমার ছাত্রদলই যথেষ্ট। আর মাগুরা উপনির্বাচনের কথা না হয় না-ই বললাম! বিএনপির ঔদ্ধত্য জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। তার ফল দেখা গেল ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামল তুলনামূলকভাবে ভালো। দ্রব্যমূল্য ছিল নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সে সময় জয়নাল হাজারীর মতো কয়েকজন গডফাদারের উদ্ভব ঘটেছিল। এরা যখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল দেশজুড়ে, সৃষ্টি করছিল সন্ত্রাসের আবহ, তখন সরকার ছিল নীরব। তারও ফল পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর হাওয়া ভবন, গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র, ‘লুকিং ফর শত্রুজ’-এর মতো অনেক কাণ্ড ঘটানো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়স বাড়ানো ইত্যাদি ঘটনা বিএনপির সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। প্রশাসনের স্তরে স্তরে নিজেদের লোক এনে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার পাঁয়তারাও দেখা গিয়েছিল। এরপর ঘটনা পরম্পরায় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় ওয়ান-ইলেভেনের জন্ম হলো।
৪.
ধরে নিচ্ছি নির্বাচন হবে। ওপরে যা বলা হলো, সেদিকে খেয়াল রাখলে দেখা যাবে, এবারও জনগণ ভোট দেওয়ার সময় প্রতিযোগী দলগুলোর দেহভাষা, বক্তৃতামালার দিকে নজর রাখবে। জনগণ এটাও দেখবে, বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোন দল কতটা বিনয়ের সঙ্গে কথা বলছে। ভাষা হিসেবে ঔদ্ধত্যকে জনগণ কখনোই গ্রহণ করেনি। শুধু জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে জাতির শক্তিশালী নেতা কখনো কখনো যে শক্তিশালী অবস্থান নেন, সেটা গোটা জাতির জন্য দরকারি হয়ে পড়ে। কিন্তু তা ঔদ্ধত্য নয়, তাঁর মধ্যেও প্রতিদ্বন্দ্বীকে সম্মান করতে হয়।
এবার যে দলগুলো নির্বাচনী মাঠকে সরগরম রাখবে, তাদের চেহারা ইতিমধ্যেই উন্মোচিত হয়ে গেছে। ক্ষমতায় আসার আগেই একেক দলের দেহভাষা আর বক্তৃতার ভাষায় যে ইনার মিনিং ছিল, তা জনগণকে খুব একটা স্বস্তি দিতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। ক্ষমতায় অন্তর্বর্তী সরকার থাকলেও প্রশাসনের বিভিন্ন চেয়ার দখল করে নিয়েছেন এখনকার সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর লোকেরা। প্রশাসনে যোগ্যতার শর্ত যদি হয় কেবল আওয়ামী-বিরোধিতা, তখন তা কতটা সক্রিয় হতে পারবে, সেটা ভেবে দেখলেই বোঝা যায়। দেশ গড়ার রোডম্যাপের পরিবর্তে যখন রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী কর্মী বা আওয়ামী দোসর খোঁজে, তখন তাদের ভাবনায় প্রজ্ঞার অভাবই দৃষ্টিগোচর হয়। আর এ কথাও তো সত্যি, চ্যাটজিপিটির এই যুগেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী হতে হলে মাঠের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। হাতের স্মার্টফোনটা সব মুশকিল আসান করে দেবে না।
ভোট হচ্ছে ধরে নিয়েই বলছি, মানুষের মনের ভাষা পড়তে হলে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে হয়। মানুষকে প্রজাতন্ত্রের মালিক বলে মেনে নিতে হয়। সদ্যগঠিত তরুণদের দলটিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বক্তৃতাগুলো লক্ষ করুন। তাঁরা যা নসিহত করছেন, তাতে ঘৃণা আর ক্ষমতা প্রদর্শনের এত বাহুল্য কেন? কেন দেশগড়ার জন্য তাঁদের নিজেদের কী পরিকল্পনা রয়েছে, তা নিয়ে তাঁরা জনগণের কাছে যাচ্ছেন না?
নির্বাচনের দিন প্রতিটি মানুষ মাত্র একটি ভোট দিয়েই রায় দেবেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মানুষের সেই রায়ের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। আর যদি নির্বাচনেও পূর্বনির্ধারিত কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা থাকে, তাহলে তা হিতে বিপরীত হবে কি না, সেটাও ভাবনায় রাখা দরকার। এত কিছুর পর কেউ চাইবে না, থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়ের জগতে ফিরে যাক জাতি।
লেখক:– উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা