Image description

গত বছরের জুলাই আন্দোলন দমাতে আশুলিয়া থানার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকহারে গুলি ছোড়ে পুলিশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গেট, নবীনগর, পল্লী বিদ্যুৎ ও বাইপাইলের একাধিক জায়গায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবৈধ অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে প্রায় প্রতিদিনই গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

গত ১৬ই জুলাই থেকে ২০শে জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে স্পেশাল পারপার্স অটোমেটিক শটগান (স্পার্স) দিয়ে অন্তত ১৩২২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে পুলিশ। আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় পুলিশের করা ৫টি মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। মানবজমিন অনুসন্ধানে আন্দোলনে কোন স্পটে পুলিশের কোন সদস্য কতো রাউন্ড গুলি ব্যবহার করেছেন ও কি ধরনের অস্ত্র থেকে এসব গুলি ছোড়া হয়েছে তাও বিস্তারিত জানা গেছে। যার নথিপত্র মানবজমিনের হাতে রয়েছে। আন্দোলনকারীদের অনেকের চোখে-মুখে, বুকে, পিঠে ও হাতে-পায়ে ভারী সিসা বল কার্তুজ ছররা গুলির ক্ষত পাওয়া যায়। এ ছাড়া তিনদিনে শটগানের গুলিতে আশুলিয়ায় অন্তত দেড় শতাধিক মানুষ আহত হন। অনেকে গুলিতে চোখও হারিয়েছেন। এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ১৫ই জুলাই থেকে আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন।

পুলিশ দফায় দফায় জবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। তবে তাতেও আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। পরে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে একাধিক মামলা দেয়া হয়। ১৮ই জুলাইয়ের পর আন্দোলন আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। যোগ দেন সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। পরে পুলিশ আন্দোলনকারীদের গণগ্রেপ্তার করতে আশুলিয়া থানায় ৬টি মামলা দেয়। মামলায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়। প্রায় ২ শতাধিক ব্যক্তিকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। মামলাগুলো করেন এসআই শরীফ আহমেদ, এসআই মো. ফজলার রহমান, এসআই মুহাম্মদ মোতালেব, এসআই সোহেল মোল্লা ও এসআই আনোয়ার হোসেন। 

রণক্ষেত্র হয় ইপিজেড এলাকা: ২০শে জুলাই আশুলিয়া নতুন ইপিজেডের সামনে নবীনগর চন্দ্রা মহাসড়কে স্থানীয় কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা চালায় পুলিশ। এতে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে বিপুলসংখ্যক রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে পুলিশ। গুলিতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়। এদিন শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন এএসআই আরঙ্গজেব ১৫০ রাউন্ড, এএসআই নুর আলম ১৩৫ রাউন্ড, নায়েক জাহিদুল ১১০ রাউন্ড, কনস্টেবল শহিদুর ৬০ রাউন্ড, মোশারফ ৯৫ রাউন্ড, মাহমুদ ১০ রাউন্ড। কনস্টেবল শামীম ২৫ রাউন্ড, মামুন রেজা ৪, জুয়েল চৌধুরী ৫, হাবিব ৩, মো. জাহাঙ্গীর ৫, রবিন ৭, মোহাম্মদ আলী ৬, শামীম ৩, ডিএসবি এএসআই রাজু ৪ রাউন্ড, ডিএসবি এএসআই সোহেল ৩ রাউন্ড। কনস্টেবল ওবায়দুর ৬ রাউন্ড, হানিফ ৭, শাহ আলম ৭, হৃদয় ৮, মামুন ১০, পায়েল ৯, মেহেদী ৭, মতিউর ৮, তুষার ৪, সঞ্জয় ৯, আরিফ ৭, সাহেদ ৪ ও রুহুল ৩ রাউন্ড। ১৮ই জুলাই নবীনগর ট্রাফিক বক্সের সামনে আন্দোলনকারীর সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ১৫৪ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এদিন শটগানের গুলিতে অনেকে হতাহত হয়ে আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। কয়েকজনকে হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যারা গুলি ছোড়ে তাদের মধ্যে রয়েছে- কনস্টেবল শামীম ২৫ রাউন্ড, মামুন রেজা ৪ রাউন্ড, জুয়েল চৌধুরী ৫ রাউন্ড, হাবিব ৩ রাউন্ড, মো. জাহাঙ্গীর ৫ রাউন্ড, রবিন ৭ রাউন্ড, মোহাম্মদ আলী ৬ রাউন্ড, শামীম ৩ রাউন্ড, ডিএসবি এএসআই রাজু ৪ রাউন্ড, ডিএসবি এএসআই সোহেল ৩ রাউন্ড, ওবায়দুর ৬ রাউন্ড, হানিফ ৭ রাউন্ড, শাহ আলম ৭ রাউন্ড, হৃদয় ৮ রাউন্ড, মামুন ১০ রাউন্ড, পায়েল ৯ রাউন্ড, মেহেদী ৭ রাউন্ড, মতিউর ৮ রাউন্ড, তুষার ৪ রাউন্ড, সঞ্জয় ৯ রাউন্ড, আরিফ ৭ রাউন্ড, সাহেদ ৪ রাউন্ড, রুহুল ৩ রাউন্ড। 

১৬ই জুলাই বিকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসভবনের সামনে জড়ো হলে পুলিশ তাদের লাঠিচার্জ করে। পরে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এদিন ৪৬৪ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। যারা গুলি করেন তাদের মধ্যে ছিলেন- কনস্টেবল হিমেল ৭ রাউন্ড, কাজী কুয়াজ ৮ রাউন্ড, রাসেল ১৭ রাউন্ড, এএসআই সানাউদ্দিন ৬ রাউন্ড, এএসআই মামুন ৭ রাউন্ড, এএসআই সরোয়ার ১০ রাউন্ড, তানভীর ১৮ রাউন্ড, শাকিল তবিউর ৩০ রাউন্ড, রাশেদ ২১ রাউন্ড, রাশেদ হোসেন ১০ রাউন্ড। রাশেদুল ১৯ রাউন্ড, এএসআই নাঈম ২৭ রাউন্ড, এএসআই লোকমান ১৬ রাউন্ড। কনস্টেবল আশিক ৭ রাউন্ড, ফাইজুর ১৪ রাউন্ড, রনি ২৬ রাউন্ড, সাদ্দাম ১১ রাউন্ড, খাদিজা ২১ রাউন্ড, শফিউল ৮ রাউন্ড, ওবায়দুল ১৪ রাউন্ড, সজল ১০ রাউন্ড, মুকুল ৩৩ রাউন্ড। ঢাকা জেলা উত্তর ডিবি কনস্টেবল নয়ন, ১০ রাউন্ড, অহিদ ১০ রাউন্ড, সাদিকুল ১০ রাউন্ড, আমির হামজা ১০ রাউন্ড, মামুন ১৫ রাউন্ড, জাহিদ ১০ রাউন্ড। 

সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. নাজমুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, স্পেশাল পারপার্স অটোমেটিক শটগান (স্পার্স) আন্দোলনে এই অস্ত্রটি ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হয়। এটা নামে শটগান হলেও আদতে প্রাণঘাতী অস্ত্র। কারণ এতে এন্ট্রি বুলেট ব্যবহার করা যায়। মেটাল ফরিং বুলেট, যেটা গাড়ি ছিদ্র্র করে বের হয়ে যাবে। এই বুলেট যদি কারও শরীরে লাগে, তার কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। এই অস্ত্র নিয়ে রাবার বুলেট, ছররা গুলিও ছোড়া যায়। এজন্যই এর নাম হয়েছে স্পেশাল পারপার্স অটোমেটিক শটগান।