
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণে তৈরি হচ্ছে থার্ড টার্মিনাল। ফ্লাইট ও যাত্রী চলাচল সহজ করার স্বপ্ন নিয়ে এ প্রকল্প শুরু হলেও পিছু ছাড়ছে না সংকট। একের এক জটিলতায় আটকে আছে উদ্বোধন ও উড়োজাহাজ ওঠানামা। নির্মাণকাজের ঠিকাদার দক্ষিণ কোরিয়ার বহুজাতিক কোম্পানি স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশনের বিল নিয়ে টানাপোড়েনের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে জাপানি চার প্রতিষ্ঠানের শর্ত। এতে পিছিয়ে যাচ্ছে সব কাজ, সংশয় দেখা দিয়েছে নির্ধারিত তারিখে উন্মুক্তকরণ নিয়েও।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রায় সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকায় থার্ড টার্মিনাল নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হলেও ২০২৩ সালের অক্টোবরে অপরিণত অবস্থায় ‘নির্বাচনি’ উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু তা বিমান চলাচলের জন্য খুলে দিতে পারেনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এরপরও দফায় দফায় তারিখ দেওয়া হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এ টার্মিনাল উন্মুক্ত করার কথা রয়েছে। এই তারিখ নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়।
জানা গেছে, কিছু কাজের জন্য এক হাজার কোটি টাকা দাবি করেছে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন। সে টাকা এখনো পরিশোধ করা হয়নি, আবার এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কোনো সমঝোতাও হয়নি। এতে আটকে আছে বেশকিছু অবকাঠামো নির্মাণকাজ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাপানি প্রতিষ্ঠান হামেদা এয়ারপোর্ট, নারিতা এয়ারপোর্ট, সুমিতোমো ও নিক্কনকুরির বিভিন্ন জটিল শর্ত।
প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কিছু বিষয়ে মতানৈক্য তৈরি হওয়ায় পরিচালনা চুক্তি করতে পারছে না বেবিচক। এতে ডিসেম্বরের মধ্যে কোনোরকমে নির্মাণকাজ শেষ করলেও কার্যক্রম শুরুর সম্ভাবনা নেই। আবার প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তি মেনে নিলেও দেখা দেবে নানামুখী সংকট। বাড়তে পারে পরিচালন ব্যয়, খরচ বাড়বে বিদেশি এয়ারলাইনস ও যাত্রীদের। একই সঙ্গে আয় কমতে পারে বেবিচকের।
কয়েকটি সূত্র জানায়, বেবিচকের সঙ্গে জাপানি চার প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা চুক্তি হওয়ার কথা। একগুচ্ছ অবাস্তব শর্ত জুড়ে দেওয়ায় তা আর হয়নি। এ ছাড়া টার্মিনাল পরিচালনার জন্য বেবিচককে অগ্রিম ৩০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা থাকলেও তা দিতে রাজি হচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। এ নিয়ে বেবিচক কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। আবার নিয়ম অনুযায়ী থার্ড টার্মিনাল পরিচালনায় বেবিচক টেন্ডার আহ্বান করার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ওই চার প্রতিষ্ঠান।
বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি না থাকায় নাম গোপন করে বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলেন, জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর শর্ত মেনে চুক্তি করলে থার্ড টার্মিনালে গাড়ি পার্কিংসহ অন্যান্য সার্ভিস চার্জ অনেক বাড়বে। এ খরচ গিয়ে পড়বে দেশি-বিদেশি যাত্রীর ওপর, তৈরি করতে পারে অস্বাভাবিক চাপ। শর্তগুলো বাস্তবসম্মত করতে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে বেবিচক। শিগগির সমঝোতা হবে বলে তারা আশাবাদী।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশনের এক হাজার কোটি টাকা দাবি এবং বিষয়টি নিয়ে তারা যে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে, তা স্পর্শকাতর পর্যায়ে আছে। আন্তর্জাতিক কোনো কোম্পানি রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের অর্থ না পেয়ে আইনের আশ্রয় নিলে তা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আস্থাহীনতা তৈরি হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ‘চুক্তি লঙ্ঘনকারী দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। পরিণতি হিসেবে অবকাঠামো খাতসহ অন্যান্য বেসরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগ স্থবির হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বেবিচক জানায়, স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশনের বিষয়টি মীমাংসার জন্য ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন কমিটি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা হবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। তবে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানটি কাজের অর্থ পাবে বলে ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত কমিটি।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক আমার দেশকে বলেন, সার্বিকভাবে সব বিষয়ে সমঝোতা ও মীমাংসার জন্য আলোচনা চলছে। খুব সুন্দর ও সন্তোষজনক সমাধান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।