
বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের। ছিনতাইকারীর কবলে পড়া এক ভুক্তভোগী থানায় গিয়ে হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনায় শুক্রবার এই থানার চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতারের পাশাপাশি ছিনতাইকৃত মোবাইলও উদ্ধার করেছে পুলিশ।
ছিনতাইয়ের ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় বৃহস্পতিবার একটি মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী। এ ঘটনার পর মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনও করেছে স্থানীয়রা।
এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রতি এক যুবককে ১০ লাখ টাকার হেরোইনসহ আটক করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগপত্রও লেখা হয়। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির ইশারায় তাকে পুরাতন এক মামলায় গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। তার থেকে উদ্ধার হওয়া মাদক দ্রব্য হেরোইন আদালতে জমা দেওয়া হয়নি।
পুলিশের বিরুদ্ধে ওই হেরোইন আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন প্রবাসী সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝর। ওই যুবককে আটকের পর পুলিশের লেখা একটি এফআইআর (ফাস্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করে বিষয়টি সামনে আনেন তিনি।
এফআইআর-এ ১০ লাখ টাকা মূল্যের হেরোইন উদ্ধারের বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। তবে সেটি পরে গায়েব করে পুরাতন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
মোহাম্মদপুর থানা ওসির বিরুদ্ধে এমন ঘটনায় কয়েকটি প্রমাণসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শুক্রবার (২৫ জুলাই) রাতে পোস্টটি করেন প্রবাসী সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝর।
পোস্টে এই সাংবাদিক লিখেছেন, ১০ লাখ টাকার হেরোইনসহ মামলাই গায়েব করে দিয়েছে মোহাম্মদপুরের ওসি ইফতেখার!
সূত্রে জানা যায়, এ বছরের ৭ মে রাতে জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেফতার করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। তাকে গ্রেফতারের পর মোহাম্মদপুর থানায় রাত ১২ টা ৪০ মিনিটে একটি এফআইআর লেখা হয়।
সেখানে তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ সালের ৩৬ (১) ধারার ৮ (গ) উপধারায় একটি মামলা লেখা হয়। সে মামলায় তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা বাজার মূল্যে ১০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার দেখানো হয়। মোহাম্মদপুর থানায় প্রস্তুত করা এফআইআর অনুযায়ী সে মামলাটি নম্বর দেওয়া হয় ২৪/৪৪৩।
যে মামলায় মোহাম্মদপুর থানার আরেক উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাখওয়াত হোসেনকে বাদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর কপিতে ঘটনার তারিখ ও সময় হিসেবে ৬ মে রাত ২৩ টা ৪০ মিনিট উল্লেখ করা আছে। পাশাপাশি, পরদিন ৭ মে ১০০ গ্রাম মাদক (হেরোইন) সহ আসামীকে আদালতে পাঠানোর জন্য মোহাম্মদপুর থানার আসামী চালান কপি প্রস্তুত করে আসামীর নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। যে চালান কপিতে সাদ্দাম হোসেনের নাম ৩ নম্বর সিরিয়ালে লেখা রয়েছে।
তথ্যমতে, আসামীকে আদালতে চালান কপিতে লেখা, আসামী চালান নং-২৫। কপিটির ডান পাশে লেখা ৩৯২৪৩ হারুন ও ১৮০১৩ রাকিবুল। এছাড়াও, গ্রেফতার হওয়া আসামীকে আদালতে প্রেরণ করার জন্য একটি সাধারাণ ডায়েরি (জিডি) করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
সাদ্দামকে আদালতে পাঠানোর জন্য সে জিডি সম্পন্ন করে তা রেজিস্ট্রার বই এ লিপিবদ্ধ করা হয়। যে বইটিতে জিডি নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে ৫০০। এ জিডিটি রাত ১টা ৪০ মিনিটে লিপিবদ্ধ করা হয়। জিডির নম্বর দেওয়া এ বইটির বাম পাশে লেখা, বিপি ফরম নং ৬৫, বাংলাদেশ ফরম নং ৫৩৬৫। বইটির মাঝখানে সাধারন ডায়েরী বহি লেখা রয়েছে। ঠিক তার নিচে নিয়ন্ত্রণ নং ৩৭৭ লেখা আছে এবং এক পাশে ৯২৫৩২৮ পৃষ্ঠা নাম্বার লেখা রয়েছে।
১০০ গ্রাম মাদক (হেরোইন) সহ গ্রেফতার করা সাদ্দাম হোসেনকে যে গ্রেফতারী পরোয়ানায় আদালতে পাঠানো হয়েছে। সে পরোয়ানাতে দেখা যায়, মোহাম্মদপুর থানার মামলা নং ১০ (১১) ২৩ এবং জিআর নং ১৬৬৬/২৩ লেখা রয়েছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার চার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও এক পরিদর্শককে (অপারেশন) নিয়ে একটি চক্র গড়ে তুলেছে। এ চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে এসআই আলতাফ,মল্লিক,মাহিদুল ও মোশারফ। যাদের সঙ্গে ৫ আগস্টের পর নতুন করে মোহাম্মদপুর থানায় দেওয়া বর্তমান ইনচার্জ (অপারেশন) যুক্ত হয়েছেন।
এরা মোহাম্মদপুর থানায় কে গ্রেফতার হবে, কাকে কখন আটক করতে হবে সবকিছু নির্ধারন করে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করে। এছাড়াও, মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকা আবাসিক হোটেল, ফুটপাত ও ব্যবসায়ীদের থেকে দৈনিক এবং মাসিক হিসেবে টাকা আদায় করে। কেউ যদি রাত ১১টার পর মোহাম্মদপুরের কোন এলাকায় দোকান খোলা রাখে, তাহলে তার বিনিময়ে তাদের টাকা দিতে হয়। অন্যথায় তাদের আটক করে থানায় নিয়ে আসার মতো ঘটনা ঘটে। তবে এমন ঘটনাগুলোর পরও মামলা থেকে বাঁচতে ভয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি।
১০০ গ্রাম মাদক (হেরোইন) উদ্ধারের ঘটনায় যুগান্তরের হাতে আসা এফআইআর কপিতে লেখা মামলার বাদী মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাখওয়াত হোসেন বলেন, ঘটনার দিন আমি, এসআই আলতাফ, এএসআই সাত্তার রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের পাশে মোটরসাইকেলে ডিউটি করছিলাম। ওই সময় জেনেভা ক্যাম্প থেকে আলতাফের কাছে এক সোর্স ফোন করে বলে জেনেভা ক্যাম্পে মারামারি লাগছে। তখন আমরা জেনেভা ক্যাম্পের ভেতর যাই। ওই সময় কয়েকজন লোক বলে ম্যানেজার সাদ্দামকে তারা আটক করেছে আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে। আমরা তখন ম্যানেজার সাদ্দামকে থানায় এনে দেখি তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে এফআইআর কপিতে কে বাদীর জায়গায় আমার নাম দিছে তা আমি জানিনা। থানায় তো আমার বিপি নাম্বার, মোবাইল নাম্বার ঠিকানা সবই দেওয়া আছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলী ইফতেখার বলেন, ওইদিন থানায় অনেক আসামি ছিলো। ভুলবশত ডিউটি অফিসার একজনকে নিয়ে চালান কপিও লিখে ফেলছে। এটা সে স্বীকার করছে। এটা নিয়ে একটা তদন্ত চলতেছে। ইতোমধ্যে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এর মধ্যে কারা যেন সুযোগ নিয়ে একটা এফআইআর কপি বানিয়ে সেটা দিয়ে দিয়েছে। এ ঘটনায় থানার লোকজন জড়িত না থাকলে কিভাবে এতো কাগজপত্র বাহিরে যায়। থানার কেউ না কেউ জড়িত আছে।
এ ঘটনায় ডিএমপি তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জুয়েল রানা জানান, এ বিষয়ে আমরা এতদিন অবগত ছিলাম না। একজন প্রবাসী সাংবাদিকের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি। এ বিষয়ে আমরা অধিকতর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপস) এসএন নজরুল ইসলাম বলেন, যদি এমন কোন ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে অবশ্যই আমরা তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।