Image description
বিশ্লেষকদের মত

নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি চালু নিয়ে বিতর্ক চলছেই। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ (বিএনপি) নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশে নতুন এ পদ্ধতি চালুর বিপক্ষে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী, তরুণদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি দল এ পদ্ধতি চালুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। পিআর পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এমন অবস্থানে বিপাকে রয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ ইস্যুতে কোনোভাবেই উপসংহারে আসতে পারছে না প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন এ কমিশন। ফলে আগামী নির্বাচনে পিআর ইস্যুটিই বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে আসছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত অনেক দেশে এ পদ্ধতি চালু থাকলেও, তা নিয়ে সংকটে রয়েছে দেশগুলো। কোনো কোনো দেশ পিআর চালু করে তা থেকে আবার ফিরে আসার চিন্তাভাবনা করছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালুর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পান না তারা। এ ছাড়া পিআর করলে এ দেশে সরকার গঠনই কঠিন হয়ে যাবে বলেও মত তাদের।

বিশ্লেষকদের মতে, পিআর পদ্ধতি মোটেও জাদুর কাঠি নয়। সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাংবিধানিক সংস্কার ও জনসচেতনতা। বিশ্বমানের ডাকসাইটে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফ্রেজার ইনস্টিটিউটের মতো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সিদ্ধান্ত দিয়েছে, পিআর পদ্ধতিকে যতটা ন্যায্য ও সাম্যবাদী মনে হয়, ততটা মোটেই নয়। বরং পৃথিবীর যে দেশেই পদ্ধতিটির প্রয়োগ রয়েছে, সে দেশেই শাসনতান্ত্রিক জটিলতা না কমে; বরং বেড়েছে। হানাহানি, বিভাজন, সংকীর্ণতা, অনৈক্য ও ক্ষুদ্র স্বার্থের লড়াই বেড়েছে।

অনুন্নত দেশে পিআর পদ্ধতির সবচেয়ে বাস্তব সমস্যা হলো—প্রায়ই জোট সরকার গঠনে রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য থাকে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো—পিআর ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের প্রতি জনগণের প্রত্যক্ষ চাপ বা জবাবদিহি কম থাকে। এ ব্যবস্থা কোনো দেশ বা সমাজের মধ্যে জাতিগত, ধর্মীয়, আঞ্চলিক বা সম্প্রদায়গত বিভাজন বাড়িয়ে তুলতে পারে। কারণ, এ ব্যবস্থায় বিশেষ সম্প্রদায়ভিত্তিক দলগুলো সহজেই সংসদে প্রতিনিধিত্ব পেতে পারে, যা বিভাজনমূলক রাজনীতির জন্ম দেয়। বিশেষ করে এ ব্যবস্থায় ছোট দলগুলো অনেক সময় অতিরিক্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তারা জোট সরকারের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এসব দল তখন নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করতে পারে এবং বড় দলগুলো বাধ্য হয়, তাদের শর্ত মানতে। সাম্প্রতিক সময়ে পিআর পদ্ধতির কারণে উন্নত রাষ্ট্র ইতালিতে বারবার সংকট তৈরি হয়েছে।

আবার পিআর পদ্ধতিতে এককভাবে ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে সরকার গঠন সম্ভব হয় না। ফলে ছোট দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জোট সরকার গঠন করতে হয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলোই পিআর পদ্ধতি অনুসরণে লাভবান হয়, অনুন্নত দেশগুলো সহজে জটিলতা এড়াতে পারে না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশ ছোট দেশ। এত ছোট দেশ যে, এ দেশে পিআর সিস্টেম চালু করলে খরচ বেড়ে যাবে। ট্যাক্সের টাকার নতুন ব্যয় তৈরি হবে। এ ছাড়া পিআর করলে এ দেশে নিম্নকক্ষে সরকার গঠনই কঠিন হয়ে যাবে। দেশের প্রেক্ষাপটে নিম্নকক্ষে আনুপাতিক সিস্টেম যথার্থ হবে না। কারণ, এখানে এককভাবে কোনো দল সরকার গঠনই করতে পারবে না।

আইন বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, ভোটারের অধিকার ও প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনকে প্রাধান্য না দিয়ে কিছু ছোট দলের দলীয় প্রধানের প্রভাব-কর্তৃত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া হচ্ছে। কালবেলাকে তিনি বলেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে অনেক ছোট রাজনৈতিক দল আছে, যারা ৫-৭ শতাংশ ভোট পায়; কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট সংসদীয় আসনে জয় লাভ করতে পারেন না, তারাই পিআর পদ্ধতির পক্ষে। কারণ, পিআর পদ্ধতিতে ভোট হলে অন্তত তারা পাঁচ থেকে ১০টি আসনে নির্বাচিত হতে পারবেন। কিন্তু বড় দলগুলো ভোট বেশি পেলেই নির্দিষ্ট সংসদীয় আসনে বিজয়ী হতে পারেন, সে কারণে তারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চান না।

তিনি আরও বলেন, এ উপমহাদেশে নির্বাচন চালু হয়েছে ১৯১৯-২০ সালের দিকে। ১০০ বছর ধরে নির্দিষ্ট আসনে ভোট বেশি পেলে কোনো প্রার্থী বিজয়ী হন। আর পিআর পদ্ধতিতে দল নির্ধারণ করবে, কোন আসনে কোন প্রার্থী বিজয়ী হবে। অর্থাৎ আমার প্রার্থী নির্বাচনে আমি ভোট দেব; কিন্তু সে বেশি ভোট পেলেও বিজয়ী হবেন কি না, তা দল নির্ধারণ করবে। কোনো দল আনুপাতিক হারে ২০টি আসন পেলে ওই দলের প্রধানরা কোন কোন আসন নেবেন, তা ঠিক করবে। দল কত আসন পেল, তার ভিত্তিতে সংসদ সদস্য হবেন। এ ক্ষেত্রে ভোটারের অধিকার হরণ করা হবে।

ড. শাহদীন মালিক আরও বলেন, পিআর পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কী হবে, তা-ও অস্পষ্ট। এ জটিল সমীকরণ সাধারণ মানুষকেও বোঝানো কষ্টকর। তাই রাতারাতি প্রচলিত ভোটের পদ্ধতি পাল্টে ফেলার যৌক্তিকতা একেবারেই কম। পিআর পদ্ধতি হলে ছোট দলগুলো কিছু আসন পাবে, যা নির্ধারণে সেই দলের প্রধানের প্রভাব থাকবে। এর বাইরে ভোটারের কথা, প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের কথা বিবেচনা করা হবে না। এতে ভোটাররা ভোটদানেও নিরুৎসাহিত হবেন।

ইসরায়েলসহ ৮৫ দেশে আছে পিআর পদ্ধতি: জানা যায়, ১৭৭৬ সালে আমেরিকান বিপ্লবের সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস তার প্রভাবশালী পুস্তিকা ‘থটস অন গভর্নমেন্ট’-এ আনুপাতিকতার প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে আধুনিক বিশ্বে সর্বপ্রথম ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি দেশ (মতান্তরে ৮৫টি), অর্থাৎ প্রায় ৫৪ শতাংশ রাষ্ট্র কোনা না কোনো ধরনের পিআর পদ্ধতি অনুশীলন করে। মূলত উন্নত বিশ্বে পিআর পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বেশি। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডির ৩৬টি সদস্য দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন ও লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশে এই ব্যবস্থা প্রচলিত।

পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়নের একাধিক উপায়ের মধ্যে তালিকাভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা ৮৫টি দেশে রয়েছে। মিশ্র সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা ছয়টি দেশে ব্যবহৃত হয়। আর একক স্থানান্তরযোগ্য ভোটদান ব্যবস্থা আয়ারল্যান্ড, মাল্টা, অস্ট্রেলিয়ার সিনেট ও ভারতের রাজ্যসভা সদস্য নির্বাচনে ব্যবহৃত হয়।

মোটামুটিভাবে ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি (আংশিক), এশিয়ায় ইসরায়েল, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়া, লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা, উত্তর আমেরিকায় আংশিকভাবে এবং কানাডার পিআর পদ্ধতিই উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আলবেনিয়া, আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, আরমেনিয়া, অস্ট্রিয়া, বলিভিয়া, বসনিয়া, হার্জেগোভিনিয়া, চিলি, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েডর, এলসালভেদর, এস্তোনিয়া, ফিজি, গুয়াতেমালা, গায়ানা, হন্ডুরাস, আইসল্যান্ড, কসোভো, লাটভিয়া, লেবানন, লুক্সেমবার্গ, মেসেডোনিয়া, মলদোভা, মন্টিনিগ্রো, নামিবিয়া, প্যারাগুয়ে, পেরু, পর্তুগাল, রোমানিয়া, সার্বিয়া, সিয়েরালিওন, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, সুরিনাম, পূর্ব তিমুর, তিউনিশিয়া, তুরস্ক, উরুগুয়ে, ওয়েলস, বুরকিনা ফাসো, বুরুন্ডি, কম্বোডিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, মোজাম্বিক, রুয়ান্ডা, টোগোসহ আরও কয়েকটি দেশে পিআর কার্যকর রয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক, লেবানন, ইন্দোনেশিয়া, পূর্ব তিমুর, তিউনিশিয়া, সিয়েরালিওন, কসোভো, বসনিয়া, আলজেরিয়া, আলবেনিয়াতে পিআর পদ্ধতি কার্যকর রয়েছে।

বিশ্বে পিআর পদ্ধতির ক্ল্যাসিক উদাহরণ হিসেবে ইসরায়েলকে সামনে আনা যায়। যেখানে পুরো দেশই একক ভোট এলাকা। যে দল মাত্র ৩.২৫ শতাংশ ভোট পায়, তারাও পার্লামেন্টে আসন পায়। এতে ছোট দলগুলো সবসময় পার্লামেন্টে প্রবেশ করে। কিন্তু এ পদ্ধতির কারণে দেশটির সরকার নানা ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জটিলতার মুখে রয়েছে।