Image description
 

আমাদের বন্ধুদের কেউ কেউ তাজউদ্দিনকে ‘বেটার দ্যান মুজিব’ প্রমাণ করতে চান। তাদের প্রমাণের ভিত্তি হলো তাজউদ্দিন ও শেখ মুজিবের পারস্পরিক জেলাসি। তাদের ধারণা শেখ মুজিব তাজউদ্দিনকে দেখতে পারতেন না এবং সেই কারণে তাজউদ্দিন ‘বেটার দ্যান মুজিব’। কী অদ্ভুত রাজনৈতিক ধারণা তাদের। ব্যক্তিগত ক্রোধ, ক্ষুব্ধতাকে তারা রাজনৈতিক ন্যারেটিভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। অবশ্য জুলাই বিপ্লবের পরবর্তীতে এমন ব্যক্তিগত ক্রোধ বা ক্ষুব্ধতার কারণে জুলাইয়ের প্রাসঙ্গিক শক্তিগুলোর মধ্যে একইধরণের বিভেদ দেখতে পাচ্ছি। বলতে গেলে আমাদের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণের চেষ্টা হচ্ছে ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতাকে কেন্দ্র করে। 

যাকগে মূল কথায় আসি। বাংলাদেশের রাজনীতি নির্ধারিত হয়েছে দুটি ক্ষেত্রে। এক ভারতবিরোধী এবং দুই হলো ভারতপন্থী বয়ানে। বাংলাদেশের ভারতপন্থী রাজনীতির সূচনাটা করেছিলেন তাজউদ্দিন। যার ফলে শেখ মুজিব পাকিস্তানের হাওলায় থাকা সত্ত্বেও তাজউদ্দিনকে বিশ্বাস করে ভারত মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারকে সমর্থন ও সহায়তা করেছিল। কারণ ভারতের ভরসা ছিল তাজউদ্দিনের  ওপর যে, সে বিট্রেয়ার হবে না। সেই সময় শেখ মুজিবের চেয়ে ভারতের বেশি দরকার ছিল তাজউদ্দিনকে। কেন দরকার ছিল তার খুব ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আক্কেল মান্দ কা লিয়ে ইশারা কাফি। 

আজ যারা তাজউদ্দিনকে ‘বেটার দ্যান মুজিব’ বলে ভাবেন কিংবা এমন একটা রাজনৈতিক বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে চান, তারা মূলত ভারতপন্থী রাজনৈতিক বয়ানকেই প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি সে তাজউদ্দিন হোক কিংবা শেখ মুজিব কারো ধারাই ভারতবিরোধী হবে না। সুতরাং তাজউদ্দিনের নামে যারা নতুন আওয়ামী লীগের ধারণা দিতে চান, তারা মূলত বাংলাদেশে ভারতপন্থী রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠার বদ চিন্তাতেই মাঠে নেমেছেন। মাঠে সেই নতুন জার্সিতে পুরানো খেলোয়াড়দেরই দেখা যাচ্ছে। 

বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান ভারতবিরোধী রাজনীতির প্রধান পুরুষ। ভারতবিরোধী রাজনৈতিক বয়ান তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটিয়ে। মূলত তৎকালীন সময়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক খোন্দকার আবদুল হামিদ জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বয়ান তৈরি ও প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান মিলিটারি থেকে আসলেও তার রাজনৈতিক চিন্তা ছিল পরিষ্কার। তিনি বুঝেছিলেন ভারত যেমন কোনোদিন বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে না, তেমনি বাংলাদেশের জনগণও কখনো ভারতকে নীতিগত সমর্থন করবে না। তিনি এই দুটো সূত্রকে এক করতে গিয়ে দেখেছিলেন, বাংলাদেশে ভারতপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যৎ নেই এবং এই রাজনীতি এদেশের গণমানুষের স্বার্থ বিরোধী। ভারতপন্থী রাজনীতি হলো অনেকটা প্রভু বদলের রাজনীতি। পাকিস্তানের শোষণের কবল থেকে বের করে ভারতীয় শোষকদের হাতে তুলে দেয়া। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের মতন বৃহৎ পরিসরের জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তা ব্যর্থ হওয়া। মানুষের সার্বিক মুক্তি ভারতপন্থী তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সম্ভব নয়। তাই জিয়াউর রহমান ভারতবিরোধী এবং বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে কাজ করবে এমন সকল শক্তিকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ছায়াতলে জড়ো করেছিলেন। যার ফলেই জিয়াউর রহমানের স্বল্পকালীন শাসনে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারতীয় বলয় থেকে বের হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সম্মানের আসনে আসীন হয়েছিল। 

তাজউদ্দিনকে কেন এখন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে সে প্রসঙ্গে একটু বলি। জুলাই বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি ক্রমান্বয়ে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এবং উঠছে। বলা যায়, রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ এখন একটি ডেড হর্স। মৃত ঘোড়াতে কেউ বাজি লাগায় না। নতুন ঘোড়ার প্রয়োজন হয়। সুতরাং ভারতপন্থী রাজনীতিকে দৌড়ের মাঠে দাঁড় করাতে নতুন ঘোড়া দরকার। সেই ঘোড়াই হলো রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ। আর সেই ঘোড়ার চালক হলেন তাজউদ্দিন। 

তাজউদ্দিনকে সামনে রেখেই দেশের সোকল্ড সুশীল সমাজের নামে সাউথ ব্লকের ব্যাকআপ টিম রাজনীতির মাঠে নামতে চাচ্ছে। এই ব্যাকআপ টিমকে পেট্রোনাইজ করছে বামেদের ছুপা রুস্তম, একটা অংশ। যারা আগে ছিল ফ্যাসিস্ট রেজিমের সকল সুবিধাভোগী, অবস্থা বেগতিক দেখে জুলাই বিপ্লবের বিপ্লবীদের সাথে তাল মিলিয়েছিল, সময় বুঝে আবার নিজমূর্তি ধারণ করতে শুরু করেছে। 

বাংলাদেশে ভারতপন্থী রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক গুরু যে কয়জন রয়েছেন, দেখবেন তারা গোলটেবিল, সেমিনার আর টকশোতে দারুণ সরব। এখানে ইনকিলাব মঞ্চের হাদির কথাটি প্রাসঙ্গিক। ফ্যাসিস্ট রেজিমে যারা কথায় কথায় রাষ্ট্রকে দোষ দিত, ফ্যাসিস্টদের না, তারাই এখন রাষ্ট্র না সরাসরি ইউনূস সরকার তথা ইন্টেরিমকে দোষ দিচ্ছে। এখন তাদের কাছে রাষ্ট্র দোষী না, রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালকরা দোষী। আর ফ্যাসিস্ট রেজিমে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালকদের নাম মুখে আনতে তাদের বাঁধতো। মুশকিল হলো খোদ ইন্টেরিমেও রয়েছেন ফ্যাসিস্ট রেজিমের শুধু রাষ্ট্রকে দায়ী করা সুশীলদের একটা অংশ। যার ফলেই ইন্টেরিমের নানান কাজে বিঘ্ন ঘটছে এবং পড়ছে প্রশ্নের মুখেও। 

জুলাই বিপ্লবের অংশীজনের মধ্যে যে বিভেদ এরজন্যও দায়ী এই ভারতপন্থী রাজনীতি এবং সেই রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক গুরুরা। এরা রয়েছে দেশের প্রতিটা রাজনৈতিক দলের মধ্যেও। এসপিওনাজ এর ভাষায় যাদের বলে স্লিপার সেল। এই সেল কাজে লাগে অন্তিম মুহূর্তে। ভারতপন্থীর রাজনীতির অন্তিম মুহূর্ত শুরু হয়েছে বলেই এই স্লিপার সেলকে জাগ্রত করা হয়েছে। আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে থেকে নিজ দলের রাজনৈতিক দর্শনের বিপরীত কথা শুনতে পারছি সে কারণেই। আর তা সেই স্লিপার সেলের সদস্যদের মুখে। তাদের চেষ্টা ক্রমেই প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। বিভেদ ও বিভ্রান্তির সুযোগ নিচ্ছে তারা। তাদের ঠেকাতে জুলাই বিপ্লবের অংশী শক্তির ঐক্যর বিকল্প নেই। ইন্টেরিম সরকারের অনেকে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন গত কয়েকদিন ধরে। ধারাবাহিক বৈঠক হয়েছে দলগুলোর মধ্যে। এই বৈঠকে অন্তত একটা কাজ হয়েছে, যা হলো, মতবিরোধ যা থাক, ফ্যাসিস্ট বিরোধিতায় সবাই এক থাকবে, এমন ঐকমত্য। তবে মনে রাখতে হবে ফ্যাসিস্টরা ভারতপন্থী রাজনীতির একটা বড় অংশ হলেও আরো ক্ষুদ্র অংশ রয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশের পক্ষে ঐকমত্য গঠন করতে হবে। সিদ্ধান্তে আসতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ভারতপন্থী রাজনীতির সাথে কোনো আপস নয়। -