Image description

 পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতি আলোচিত একটি ঘটনা। তবে পদ্মা সেতুর চেয়েও আরো বড় মাত্রায় দুর্নীতি-লুটপাট হয়েছে পদ্মা রেল সেতু প্রকল্পে। শুরুতেই এই প্রকল্পের অস্বাভাবিক হিসাব-নিকাশ দেখিয়ে প্রকল্পের ব্যয় কয়েকগুণ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে। এরপরও একনেকে অনুমোদনের মাত্র দু’বছরের মাথায় এক বারেই ব্যয় ৪ হাজার ২শ ৫৭ কোটি টাকা সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যন্ত সবকিছুই করছে চীনারা। এরসঙ্গে রেলেরও একাধিক কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাদের অন্যতম হলেন এই মো. আফজাল হোসেন, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক পদে আসীন আছেন। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট, লুটেরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ শেখ রেহানার পছন্দের কর্মকর্তা এই আফজাল হোসেন পদ্মা রেল সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পদেরও দায়িত্ব পেয়েছিলেন এক পর্যায়ে। এই আফজাল হোসেনের হাত দিয়েই প্রকল্পের অস্বাভাবিক ব্যয় ও ভুয়া হিসাব-নিকাশ দেখিয়ে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। আফজাল হোসেন নিজেও চীনা ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে প্রতিটি বিল পরিশোধের ওপর বড় অংকের কমিশন পেয়েছেন। এছাড়া সাব-ন্ট্রাক্টদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারি অর্থ।এই রেল প্রকল্পে কতটা দুর্নীতি-লুটপাট হয়েছে তা সর্বশেষ সরকারের অডিট বিভাগের প্রতিবেদনেই কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। দুর্নীতি-লুটপাটের কারণে পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পে ১৩,৩৬১ কোটি ৫২ লাখ টাকা সরকারের আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে মর্মে মহাপরিচালক, অডিট অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে যিনি আছেন মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান নিজে পদ্মা রেল সেতু এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে অত্যন্ত হতাশা ব্যক্ত করেছেন। আদতে পদ্মা সেতু নির্মাণের পর পদ্মা রেল সেতু নির্মাণের কোনোই প্রয়োজনীয়তা ছিল না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রকল্প ব্যয়ের পুরো ৩৯ হাজার ২শ ৪৭ কোটি টাকাই জলে গেছে। 


প্রকল্পটি মূলতঃ হাতেই নেয়া হয়েছিল লুটপাটের ধান্দাকে সামনে রেখেই। এর প্রমাণ পাওয়া যায় প্রকল্পের অধীন একটি রেল স্টেশন নির্মাণের চিত্র থেকেই। ফরিদপুরের ভাঙ্গা রেলস্টেশন, যেখানে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা ব্যয়ই যথেষ্ট ছিল সেই রেল স্টেশনে ব্যয় করা হয়েছে ১৫০ কোটি টাকারও বেশি। মূল প্রকল্পে এখানে বিপুল ব্যয়ে রেল স্টেশন নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেনই অন্য কৌশলে এটিকে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অবাক ব্যাপার হলো, উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রকল্পটির অপব্যয়, দুর্নীতি-লুটপাটে হতাশা ব্যক্ত করলেও তাঁরই আবার অতি পছন্দের কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক, দুর্নীতির মূল হোতা মো. আফজাল হোসেন। হাসিনা-রেহানার পছন্দের এই আফজাল হোসেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের এতটা পছন্দের যে, তিনি এই কর্মকর্তার অতীত এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের মতো সর্বোচ্চ পদে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছেন। যা নিয়ে বিগত মাসগুলোতে রেল বিভাগে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলে আসছে এবং এখনো তা থামেনি। শুধু রেল বিভাগেই নয়, বহুল আলোচিত পদ্মা রেল সেতু প্রকল্পের পরিচালক, দুর্নীতিবাজ আফজাল হোসেনকে রেলের ডিজি পদে পদোন্নতির ঘটনা গোটা সরকারেই আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সরকারের পারফরমেন্সের বিষয়ে মৌখিকভাবে অনেকে এটিকে নেতিবাচকভাবে উদাহরণ হিসেবেও তুলে ধরছেন।  


উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি ছিল পদ্মা সেতুর দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক এই সেতু নির্মাণে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। এরপরেই এক পর্যায়ে চীনের সঙ্গে সেতু নির্মাণের চুক্তি হয়। চীনও বাংলাদেশ সরকারের এ প্রকল্প থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মওকা পেয়ে যায়। দুর্নীতিবাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাকে হাতে নিয়ে দফায় দফায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে নেয়। অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা হয়। ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার কোটি টাকায়। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দফায় দফায় এভাবে অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়ানো নিয়ে অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে হাসিনা সরকারকে। আর তাই পরবর্তীতে পদ্মা রেল সেতু প্রকল্পটির ডিপিপি তৈরির সময়ই ভুয়া হিসাব-নিকাশ দেখিয়ে ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ধরা হয়, যাতে ব্যয় বাড়ানো নিয়ে আর প্রশ্নের মুখে পড়তে না হয়। চীনের সঙ্গে হাসিনা-রেহানার ভাগবাটোয়ারার সমঝোতাই এটি করা হয়। দেখা গেছে, প্রকল্পটির ডিপিপি তৈরি থেকে একনেকে অনুমোদনের আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটি কাজে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি একনেকে অনুমোদনের পরও এই প্রকল্প নিয়ে নানা রকমের লুকোচুরির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। যেহেতু এই রেল প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই থেকে প্রকল্পকাজ বাস্তবায়নের শেষ পর্যন্ত চীনারাই সবকিছু করবে, এটা হাসিনা-রেহানার সঙ্গে সমঝোতায় আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল, তাই অন্যদের এ বিষয়ে জানার সুযোগও ছিল কম। এমনকি এই প্রকল্পের ডিপিপি তৈরিতেও চীনাদের পরোক্ষ হাত ছিল।

 

এই প্রকল্পটির ঠিকাদার নিয়োগে দর যাচাই হয়নি। সরাসরি চীনারা কাজ পেয়েছে। এ কারণে প্রকল্পের ঘাপলা বা ভুয়া হিসাব-নিকাশ যাচাই করারও সুযোগ হয়নি। এরপরও একনেক অনুমোদনের মাত্র দুই বছরের মাথায় ২০১৮ সালে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৩৯ হাজার ২শ’ ৪৭ কোটি টাকা করা হয়। এর আগে ২০১৬ সালে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের সময় এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯শ’ ৮৯ কোটি টাকা। বস্তুত, প্রকল্পটি যখন হাতে নেয়া হয় বা ২০১৬ সালে যখন একনেকে অনুমোদিত হয় ওই সময় দেশে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিজম আর লুটপাটতন্ত্র পুরো মাত্রায়ই কায়েম হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লুটপাটতন্ত্রের অন্যতম ঘটনা ছিল এই পদ্মা রেল সেতু প্রকলপটি। প্রকল্পটিই ছিল মূলতঃ অপ্রয়োজনীয়, তাছাড়া সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রকল্পটি নিয়ম অনুযায়ী সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ব্যয়িত অর্থের এক তৃতীয়াংশেরও কম টাকা এতে খরচ হতো। অর্থাৎ এই প্রকল্পের প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকাই অপব্যয়, আত্মসাত ও লুটপাট করা হয়েছে, যদিও অডিট আপত্তিতে ১৩ হাজার ১৩১ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান চাকরিজীবনে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে ২০০৯ সালে অবসরে যান। তিনি বরাবরই নিজেকে একজন সৎ এবং দক্ষ হিসেবে দাবি করে থাকেন। আর তাই অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাকে উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্ব দিয়েছেন। এরমধ্যে রয়েছে রেল বিভাগ, সড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। সরকারের উন্নয়ন খাতের অন্তত দুই তৃতীয়াংশ অর্থ এই বিভাগগুলোর মাধ্যমে ব্যয়িত হয়ে থাকে। আওয়ামী আমলে লুটপাটও হয়েছে সেই অনুযায়ীই বড় আকারের। সম্প্রতি এসব লুটপাটের বিষয়ে এবং লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল শীর্ষকাগজের পক্ষ থেকে। কিন্তু উপদেষ্টা এসব নিয়ে কথা বলতেই রাজি হননি।


শীর্ষনিউজ