
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে দুই জন শিক্ষক ছাড়া বাকি সবাই শিশু। কিন্তু গুজব ছড়িয়েছে লাশ গোপন করা হয়েছে। এই গুজবের ওপর ভর করেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। সবারই প্রশ্ন, নিহতদের পরিচয়সহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে দেরি হচ্ছে কেন?
এদিকে মাইলস্টোনসহ আশপাশের স্কুল-কলেজের ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার (২২ জুলাই) প্রায় ৯ ঘণ্টারও বেশি সময় অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন সরকারের প্রভাবশালী দুই উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সি আর আবরার এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে। শিক্ষার্থীরা প্রথমে ছয় দফা দাবি জানালেও পরে দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন। অপরদিকে বিক্ষুব্ধ আরেক দল শিক্ষার্থী সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ করতে করতে গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। সচিবালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল থেকে একজনের মৃতদেহ সিএমএইচে পাঠানো হয়েছে। সেই সংখ্যাটি নিয়ে আমাদের তথ্যের পার্থক্য দেখা দিয়েছে। আমরা বলেছি, ১৫ জন, সিএমএইচে ১৫ জনের মৃতদেহ আছে। যদিও আইএসপিআরের তথ্যে ১৬ জন বলা আছে। তথ্যের পার্থক্যগুলো দূর হতে সময় লাগবে।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু মৃতদেহ আর দেহাবশেষ নিয়ে কিছু পার্থক্য আছে, তাই বিষয়টি নিয়ে আরেকটু সময় নিয়ে জানাতে পারবো।’দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিবকে অবরুদ্ধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা
নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকেই গুজব ওঠে নিহতের সংখ্যা নিয়ে। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী শ্রেণিকক্ষে ভর্তি শিশুদের দেখলেও সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের সংখ্যা প্রথম দিন বলা হয় ১৯ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন আরও অন্তত ১০-১২ জন। মঙ্গলবার (২২ জুন) এই সংখ্যা বেড়ে ৩১ জনে ঠেকে। সোমবার (২১ জুলাই) সন্ধ্যা থেকেই এ সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ‘লাশ গোপন’ করার গুজবে হাওয়া দেয় ঘটনাস্থলে সংবাদকর্মীদের তথ্য সংগ্রহে বাধা দেওয়ার বিষয়টি। এছাড়া সোমবার রাত ১০টায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার কাজ শেষ করলেও মধ্যরাতে ঘটনাস্থলে একটি অ্যাম্বুলেন্স যাওয়া নিয়ে আবারও গুজব ছড়ায়। রাতেই মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে আসেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বরাবরের মতো এবারও ক্রাউড কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হয়েছে। উৎসুক মানুষের ভিড়ে উদ্ধারকর্মীদের কাজ করতেও বেগ পেতে হয়েছে। যদিও অনেক সাধারণ মানুষ উদ্ধারকাজে সহায়তা করেছেন। সরকারও দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে যথাযথ উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, একটি পক্ষ নিহতের সংখ্যা নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। হতাহতের তথ্য গোপন করা হচ্ছে দাবিটি অপপ্রচার। এটি কোনোভাবেই সঠিক নয়। যেসব মরদেহ শনাক্ত করা যাচ্ছে না, তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হতাহতদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
একই কথা বলেছেন বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) নিহত পাইলটকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ক্রাশ সাইটে (দুর্ঘটনাস্থল) অশান্তি বিরাজ করছে। এটা দুঃখজনক। এখানে লুকানোর বা গোপন করার কিছুই নাই। কার কাছে গোপন করবো। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই।’ তিনি দেশবাসীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানান।
পুলিশের সহায়তায় মাইলস্টোন কলেজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব
মঙ্গলবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার ও প্রেস সচিব শফিকুল আলম। কিন্তু সকাল থেকেই মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবি আদায়ের জন্য বিক্ষোভের ডাক দেন। হতাহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ, ক্ষতিপূরণ দাবি ও প্রশিক্ষণ বিমান জনবহুল এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানান তারা। দুপুরের দিকে তাদের এই বিক্ষোভে যোগ দেন উত্তরার আশপাশের স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও। একপর্যায়ে তারা দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি তোলেন। পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তাদের অবরুদ্ধ করে রাখার কথা বলা হয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, এত বড় একটি দুর্ঘটনার পরও এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দোটানায় ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গভীর রাতে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা আসে। শিক্ষা সচিবের প্রত্যাহারের দাবিও করেন শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার দুপুরে শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও দুই উপদেষ্টাকে আটকে রাখেন মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা। সরকারের পক্ষ থেকে সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও তাদের পদত্যাগের দাবি করা হয়। দুপুর থেকেই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রায় ৯ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় দুই উপদেষ্টাসহ প্রেস সচিব এবং অন্যরা কলেজ ভবন থেকে বের হয় আসেন।সচিবালয়ের সামনের সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সচিবালয় এলাকা রণক্ষেত্র
এদিকে আইন ও শিক্ষা উপদেষ্টা এবং শিক্ষা সচিবের পদত্যাগের দাবিতে আরেক দল শিক্ষার্থী বিকালে সচিবালয় এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা প্রথমে শিক্ষা ভবন ও পরে সচিবালয়ে ঢোকার চেষ্টা করেন। এসময় সচিবালয়ের সব প্রবেশ গেট ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা একপর্যায়ে সচিবালয়ের তিন নম্বর গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। তারা সচিবালয়ের ভেতরে থাকা কিছু গাড়িও ভাঙচুর করেন। পরে পুলিশ তাদের লাঠিচার্জ শুরু করে। এ ঘটনায় অন্তত ৭৫ জন শিক্ষার্থী আহত হন। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একপর্যায়ে সচিবালয়ের সামনের সড়কে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া -পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। শিক্ষার্থীরাও পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। সচিবালয়ের আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সন্ধ্যার একটু আগে গুলিস্তান এলাকাতেও ঘটে একই ঘটনা। শিক্ষার্থীরা শুধু শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার করায় সন্তুষ্ট হননি। তারা দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি করতে থাকেন। সন্ধ্যার দিকে সচিবালয় এলাকার পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।
বিদেশ থেকে আসছেন চিকিৎসক: আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসা
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হাসপাতালে ৬৮ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ফোকাল পারসন ফারহানা কবীর। এর আগে আইএসপিআর থেকে আহতের সংখ্যা দেড় শতাধিক জানানো হয়। আহতদের সংখ্যা নিয়ে গরমিল প্রসঙ্গে ফারহানা কবীর সাংবাদিকদের জানান, এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে স্থানান্তর করার কারণে সংখ্যায় গরমিল হয়েছিল।
এদিকে আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসার জন্য বিদেশ থেকে চিকিৎসক আসছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান। তিনি জানান, আহতদের চিকিৎসার জন্য অন্যান্য হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি’ আটটি টিম যোগ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ হাসপাতালের সঙ্গে যাদের চুক্তি আছে, যেমন- সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের কেস রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। তাদের একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট এবং দুজন নার্স আজ রাতে এসে পৌঁছাবেন। আশা করি তারা আগামীকাল (বুধবার) থেকে এই টিমে যোগ দিতে পারবেন।’
আহতদের মধ্যে অন্তত ৩০ জনের অবস্থা এখনও অস্পষ্ট এবং ১০ জন শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। তাদের আইসিইউতে রাখা হয়েছে।জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, আহতদের মধ্যে ৩০ জনের অবস্থা অস্পষ্ট। ১০ জন শঙ্কামুক্ত। এছাড়া ১০ জন এখনও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। বাকিদের অবস্থা মাঝামাঝি।
এদিকে আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারত থেকে মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টসহ দুজন চিকিৎসক ও নার্সদের একটি দল ঢাকায় পাঠানোর তথ্য জানিয়েছেন বিবিসি বাংলা। দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলোচনার ভিত্তিতেই ভারত চিকিৎসক দল ও ইকুইপমেন্ট পাঠাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।
মানুষ ক্ষুব্ধ, বিতর্কের মুখে সরকার
আলোচিত এই ঘটনাটি দক্ষভাবে সামলা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় একদিকে যেমন মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন, তেমনই সরকারের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। সাধারণ মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ত্রাণ তহবিলে সহায়তা চাওয়ার পোস্টটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নিহত শিশুদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না দিয়ে দাফন করতে দেওয়া, নিহতদের ক্ষতিপূরণের ঘোষণা না দেওয়া, চলমান এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা না করা নিয়ে দোটানা সিদ্ধান্ত এবং ক্রাউড কন্ট্রোল করতে না পারায় সরকারের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আল মামুন নিজের ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আগে ছিল ...লের সরকার! এখন হইছে আবালের সরকার! একটা বিষয় ঠান্ডা মাথায় গুছিয়ে ডিল করতে পারছে না।’
কবি টোকন ঠাকুর তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘একটা গণভোট হলে রাষ্ট্র পরিচালনা ও সংস্কারে ইউনূস সরকার ইন্টেরিম হওয়ারও যোগ্য কিনা, কার্যকর ও সাবালক কিনা, জনতার মতামত উঠে আসতো।’