Image description
বিআইবিএম আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বড় লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম বাণিজ্য # ৯৫ শতাংশ ব্যাংকের সনাতনী তালিকা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া # আমদানি-রফতানিতে প্রতিটি পণ্যের দাম ও তথ্য সঠিক ভাবে যাচাই-বাছাই করার তাগিদ

দেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অর্থ আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে পাচার হয়। আমদানি ও রফতানির সময় মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এই বিপুল অর্থ দেশ থেকে পাচার করা হয়। গবেষকরা জানান, পাচারের কারণে দেশের ভাবমূর্তি বিশ্বে নষ্ট হচ্ছে। আর ব্যাংকাররা বলেন, পাচার রোধে সব সংস্থার সমন্বয়ের পাশাপাশি, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে দেশ থেকে প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতিসহ আমদানি-রফতানিতে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এসব অর্থপাচার হয়।

বক্তারা বলেন, অনেক ব্যবসায়ী ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়। আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার করে থাকে। ব্যাংকাররা বলেন, পাচার রোধে নীতিমালা থাকলেও অনেকেই তা মানে না। এছাড়া অর্থ পাচারের মাধ্যমে সরকার রাজস্ব থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের অর্থনীতিও। তাই, পাচার প্রতিরোধে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের তাগিদ দেন আলোচকরা।

গতকাল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থাপিত গবেষণাপত্র এবং বিশেষজ্ঞরা এ তথ্য তুলে ধরেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে হিসাবটি করা হয়। গবেষণাপত্রে বলা হয়, ২০১৫ সালের অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন সংশোধনের পর মোট ৯৫টি টাকা পাচারের ঘটনা নিয়ে কাজ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এর সব কটিই করা হয়েছে বাণিজ্যের মাধ্যমে, যার আর্থিক পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা।
বিআইবিএমের তিন শিক্ষক, বেসরকারি ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক কর্মকর্তা মিলে ৩৭টি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন–উত্তরের তথ্য দিয়ে গবেষণাপত্রটি তৈরি করা হয়। গবেষণার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের শিক্ষক প্রফেসর আহসান হাবিব।

বিআইবিএমের গবেষক আহসান হাবীব বলেন, আমাদের মতো দেশের স্টাডি যেটা হচ্ছে সেখানে ইবিএলএমের যে পরিমাণ সেটা ৭০-৮০ শতাংশ এবং আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। তিনি বলেন, অর্থ পাচারে অপরাধীরা বাণিজ্য চ্যানেলটি ব্যবহার করে, তার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাণিজ্যর মাধ্যমে বড় পরিমাণের অর্থ নেওয়া যায়। অন্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে বাণিজ্যের মাধ্যমে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ লেনদেন করা সম্ভব হয়। ফলে এ মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাঠানোর আগ্রহ বেশি থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, যখন বিএফআইয়ের রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে এবং রিপোর্ট ইনভেস্টিগেটিং অথরিটিকে দিচ্ছে, তখনও কিন্তু স্পেসিফিক তার জন্য বলা ডিফিকাল্ট। আমি কি বলব? স্মাগলিং বলব না কোনটা বলব? এটা যখন ইনভেস্টিগেশন অথরিটির কাছে যাচ্ছে, তখন যদি কেস হয়, তাহলে এটা কোনো কোর্টে যাবে? সিভিল কোর্টে যাবে না ক্রিমিনাল কোর্টে যাবে, এটা নিয়ে একটা প্রশ্ন আছে।

এসময় ব্যাংকাররা বলেন, শুধু আইন দিয়ে অর্থপাচার রোধ করা সম্ভব নয়। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিটি পণ্যের দাম ও তথ্য সঠিক ভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে।

বিএফআইইউয়ের পরিচালক মোস্তাকুর রহমান বলেন, যে সব পণ্যের ক্ষেত্রে ওভার প্রাইজ থাকে সেগুলো বিএফআইয়ের কাছে রেফার করা হয় তাহলে আমরা এটা নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করতে পারি।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার বলেন, কম দাম দেখিয়ে আমদানি ও রফতানির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়; এটাও বাণিজ্য অর্থায়নের মধ্যে পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাণিজ্য এমনভাবে করা হয় যে বাইরের দৃষ্টিতে সব ঠিকঠাক মনে হয়। তবে ভেতরে অন্য কিছু লুকানো থাকে। অনেক সময় চোখে ধুলা দেওয়ার মতো অবস্থা হয়। বলা হয় এক কথা, আসলে ভেতরে অন্য কিছু চলছে। তাই ভালোভাবে দেখা জরুরি। নূরুন নাহার বলেন, যাঁরা বিদেশে টাকা পাচার করেন, তাঁরা কৌশলে কাজটি করেন। শুধু নিয়ম মেনে চললেই তাঁদের ধরা যাবে না। বুদ্ধি খাটাতে হয়। তাঁদের ধরতে খুব সতর্ক থাকতে হয়।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় আহসান হাবিব বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমদানি ও রফতানির সময় মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা দেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। এ সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরের তথ্য-উপাত্তও এ গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

গবেষণার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলা হয়, ২০২৪ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এই অর্থ পাচার মূলত বস্ত্র, ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানি পণ্য আমদানিতে হয়।
গবেষণায় প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, দেশে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার মোকাবিলায় পর্যাপ্ত সুরক্ষাকাঠামোতে দুর্বলতা আছে। জরিপে অংশ নেওয়া শতভাগ ব্যাংক জানায়, নিষেধাজ্ঞা তালিকা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া, অর্থাৎ আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা যাচাইয়ের সক্ষমতা রয়েছে। ৯৫ শতাংশ ব্যাংকের রয়েছে সনাতনী তালিকা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া। ১০০ শতাংশ ব্যাংকের লেনদেনের নিজস্ব তথ্যভান্ডার রয়েছে। আমদানি-রফতানি মূল্য যাচাইয়ের তথ্যভান্ডারে সুবিধা নিতে পারে ৫০ শতাংশ ব্যাংক।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বিআইবিএম’র এ কে গঙ্গোপাধ্যায় চেয়ার প্রফেসর ফারুক এম আহমেদ, বিআইবিএমের মহাপরিচালক আবদুল হাকিম, বিআইবিএমের শিক্ষক আলী হোসেইন প্রমুখ।