Image description
পাঁচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬৮ আইসিইউতে ১২, আহতের অধিকাংশই শিশু, সন্তান ফিরে পেতে কান্না মোনাজাত স্বজনদের

শ্বাসনালি পুড়ে গেছে জারিফের (১২)। পোড়ার তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণা হলেও গলা দিয়ে বের হচ্ছে না আওয়াজ। কেবল গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আনা হয়েছে জারিফকে।

রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় ৩৮ শতাংশ পুড়ে গেছে জারিফের শরীর। কিন্তু শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় শঙ্কায় স্বজনেরা। আইসিউতে চিকিৎসাধীন ছোট্ট শিশুটি। সন্তানের কষ্ট দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন জারিফের বাবা-মা। জারিফের চাচাতো ভাই সিয়াম বলেন, ‘আগুনে পোড়ার যে কী যন্ত্রণা তা চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। কোলে-পিঠে বড় হওয়া শিশুর এ অবস্থা সহ্য করা যাচ্ছে না।’

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের পঞ্চম তলায় আইসিইউর সামনে দেখা মেলে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। আইসিইউর ভিতরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে শিশুরা আর দরজার বাইরে সৃষ্টিকর্তার কাছে দুহাত তুলে সন্তানের জীবন ভিক্ষা চাইছেন স্বজনরা। বাবা-মা, স্বজনের বুকফাটা কান্নায় চোখে জল চলে আসছে স্বাস্থ্যকর্মীসহ স্বেচ্ছাসেবকদেরও। মেঝেতে গড়াগড়ি করে কাঁদছেন অনেকে। সন্তানের স্মৃতি হাতড়ে বিলাপ করছেন তারা। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও যেন হারিয়ে মাথায় বাতাস করছেন নয়তো মুখে পানি ছিটা দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক তরুণরা।

১২ বছরের মাহতাবের শরীরের ৮৫ শতাংশ ঝলসে গেছে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার আগুনে। আইসিইউয়ের সামনে উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে মাহতাবের নানি ও ছোটবোন। মাহতাবের নানি জানান, তিন ভাই বোনের মধ্যে মাহতাব মেজো। চিকিৎসকরা বলেছেন মাহতাবের শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে তার।

বার্ন ইনস্টিটিউটের ওয়ার্ডবয় মনির হোসেন বলেন, ‘২০ বছরের কর্মজীবনে হাতের ওপরে অনেক রোগী শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে। তাজরীন ফ্যাশন, চুড়িহাট্টার আগুনে পোড়া রোগীদের সেবা দিয়েছি। কিন্তু গত সোমবার রাতের মতো বিভীষিকা আমার জীবনে আসেনি। শিশুদের কান্না যেন আমার কানে এখনো লাগছে। মাঝরাতে আমার হাতের ওপরই চলে গেল ছোট্ট একটা শিশু। আমি ওই দৃশ্য ভুলতে পারছি না।’

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন ৪৪ জন। এর মধ্যে ১২ জন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। গত সোমবার বিকাল থেকে রাতের মধ্যেই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে উত্তরার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে তিনজন রোগীকে বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। বিকালে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে আরও দুজন রোগীকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয় বলে জানা গেছে। দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীদের সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি নিশ্চিত করার জন্য এ ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান জানান, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪৪ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ২১ জন, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে একজন, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন রোগী চিকিৎসাধীন। সবমিলিয়ে ৬৮ জন রোগী গতকাল চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন তিনি।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান গতকাল হাসপাতালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানান, জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ১০ জন রোগীকে শঙ্কামুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি ৩০ জন এখনো অস্পষ্ট জায়গায় আছে, যার মধ্যে ১০ জন শঙ্কার মধ্যে আছে।

তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যেই একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম কাজ করছে। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, জাতীয় কিডনি ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি ডিসিপ্লিনসহ একটি টিম সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে পর্যালোচনা করেছে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, প্রয়োজনীয় ফ্লুইড (তরল উপাদান) এবং ওষুধ পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল থেকে একজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট এবং দুজন নার্স আজকে (মঙ্গলবার) রাতে এসে পৌঁছাবেন। আমরা আশা করি, আগামীকাল (বুধবার) তারা এ টিমে জয়েন করতে পারবেন। দেশের সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞদের এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে শিশু বিশেষজ্ঞের সব ব্রাঞ্চ এ টিমের সঙ্গে যুক্ত, যেহেতু রোগীরা অধিকাংশই শিশু।’

এ সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম জানান, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবা আরও জোরদার করতে সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩১ জনে পৌঁছেছে। রোগীর আসা-যাওয়া ও বারবার হাসপাতাল স্থানান্তরের কারণে সংখ্যার বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, এটি একটি ইমার্জেন্সি পরিস্থিতি। এ তথ্যের পার্থক্যগুলো দূর হতে একটু সময় লাগবে বলে জানান তিনি।