Image description
দুর্ঘটনার নেপথ্যে

ঢাকায় মাইলস্টোন স্কুলের শিশুদের ওপর যে যুদ্ধবিমানটি আছড়ে পড়েছে, সেটার ভেতর ছিল এক তরুণ স্বপ্নবাজ মানুষ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম। সদ্যোবিবাহিত এই তরুণ কর্মকর্তা ছিলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলট, যিনি দীর্ঘ বেসিক ট্রেনিং শেষে গতকালই প্রথম একা উড়াল দেওয়ার অনুমতি পান। এটি ছিল তাঁর জীবনের ‘সোলো ফ্লাইট’, যে দিনটির জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন। কিন্তু স্বপ্নপূরণের দিনটিই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের শেষ দিন।

তৌকিরের সেই স্বপ্নের উড়াল পাখি আছড়ে পড়ে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে। মাইলস্টোন স্কুলের ১৯ শিশুর স্বপ্নও অঙ্কুরেই শেষ।

তৌকিরের প্রথম সোলো ফ্লাইট হয়ে উঠেছে জাতির জন্য চিরদিনের এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। এক তরুণের স্বপ্নভঙ্গ আর নিরপরাধ শিশুদের অকালমৃত্যু—এ দুই মিলে পুরো দেশ আজ স্তব্ধ।

তৌকিরের ফ্লাইট ছিল প্রতিটি প্রশিক্ষণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর নির্ধারিত। আবহাওয়া ও ছুটির কারণে তিন দিন দেরি হয়। অবশেষে গতকাল সকালেই প্রশিক্ষক তাঁকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে আকাশে ওড়ান, কয়েকটি চেনা প্র্যাকটিস করিয়ে নেমে যান ডুয়াল ককপিট থেকে এবং ছেড়ে দেন তৌকিরকে একা, তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ স্বপ্নপূরণের উড়ালের জন্য।

কিন্তু শেষ ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জনবহুল এলাকা থেকে বিমানটি সরিয়ে নেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে কাউকেই বাঁচাতে পারেননি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণে অংশ নিতে গিয়ে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হয়েছে।

দুপুর ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় (যার বিস্তারিত তদন্ত সাপেক্ষে জানানো হবে)।

আইএসপিআর জানিয়েছে, দুর্ঘটনা মোকাবেলায় এবং বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে।

দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে বিমানবাহিনীর একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএসপিআর।

কন্ট্রোলরুম থেকে ইজেক্ট করার নির্দেশ এসেছিল

সকালেই তৌকির ঢাকা কুর্মিটোলার পুরনো এয়ারফোর্স বেইস থেকে এফ-৭ যুদ্ধবিমান নিয়ে আকাশে পাখা মেলেন। ওপর থেকে নিচের শহরটাকে হয়তো সেদিন নতুন রকম লাগছিল তাঁর কাছে। দিয়াবাড়ী, বাড্ডা, হাতিরঝিল পেরিয়ে যখন আকাশে ভাসছিলেন, তখন হঠাৎ করেই কিছু অস্বাভাবিকতা টের পান। ইঞ্জিনে গোলমাল? ভারসাম্য হারাচ্ছে বিমান? সেই মুহূর্তে তিনি দ্রুত বিষয়টি কন্ট্রোলরুমে জানিয়ে দেন, ‘স্যার, বিমান ভাসছে না, নিচের দিকে নামছে।’

বিমান দুর্ঘটনার মুহূর্তেও তৌকির ছিলেন এক সাহসী পেশাদার। কন্ট্রোলরুম থেকে ইজেক্ট করার নির্দেশ পেলেও তিনি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যান বিমানটি বাঁচানোর। হয়তো চেয়েছিলেন জনবহুল এলাকায় যেন কোনো বড় ক্ষতি না হয়, হয়তো চেয়েছিলেন বিমানটিকে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরিয়ে আনতে। সর্বোচ্চ গতিতে বিমানটি চালিয়ে তিনি ফিরে যেতে চাইছিলেন বেইসের দিকে। কিন্তু কন্ট্রোলরুমের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

দুর্ঘটনার ঠিক আগমুহূর্তে পাইলট যখন বুঝতে পারেন যে বিমান আর উদ্ধারযোগ্য নয়, তখন নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় তিনি ইজেকশন সিট ব্যবহার করে বিমান থেকে বের হন। এটা একটা অতি দ্রুত, সময় নির্ধারিত ও জীবনরক্ষাকারী পদ্ধতি।

ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলেন, ‌বিমান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারলে মাঝ আকাশেই বিমান ছেড়ে বের হয়ে যেতে হয় পাইলটকে, ইংরেজিতে যেটিকে বলে ইজেক্ট (বের হয়ে যাওয়া)। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তাঁকে ঝাঁপ দিতে হয় প্যারাশুট নিয়ে। সেটি করতে হয় অন্তত ১০ থেকে ৩০ হাজার ফুট উচ্চতায়। বিমান ধ্বংস হলে প্রাণ বাঁচানোর এটিই একমাত্র পদ্ধতি। যুদ্ধবিমান চলে প্রচণ্ড গতিতে, আবার সেটি ধ্বংস হলেও নিচে পড়তে থাকে অনেক গতিতে। তাই এমন অবস্থায় বিমান থেকে বের হওয়া সহজ নয়। 

টেক অফ করার পাঁচ-সাত মিনিটে গোলযোগ

বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার মোহাম্মদ ওয়াহিদ উন নবী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এটা ছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি ফাইটার জেট। এই ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা বিমানবন্দর এলাকার খুব কাছে পাবলিক প্লেসে আর ঘটেনি, স্পেশালি বিমানবাহিনীর কোনো ফাইটার বিমানের।’

তিনি লিখেছেন, ‘তৌকির টেক অফ করার পাঁচ-সাত মিনিটের মাথায় ইনস্ট্রাক্টর দেখতে পান এক ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ। ফাইটার জেটটি বিমানবন্দরে উত্তর দিক থেকে ঘুরে দক্ষিণ দিকে উচ্চতা হারাচ্ছে। প্রশিক্ষক ওয়্যারলেসে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যা হওয়ার তাই—ফাইটার জেটটি এমন অবস্থায় ছিল যে নিশ্চিত বিমানবন্দরের ইন্টারন্যাশনাল পার্কিং বরাবর পড়ার কথা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তৌকির কিছু একটা করেছে হয়তো, যা বিমানটিকে অন্যদিকে ডাইরেক্ট করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ফাইটার জেটটিতে কমপ্লিট কন্ট্রোল লস-পাওয়ার লস (ইঞ্জিন ফেল) এবং রেডিও ফেইলিউর একসঙ্গে হয়েছে।’

মোহাম্মদ ওয়াহিদ উন নবী ফেসবুকে আরো লেখেন, ‘সাধারণত নতুন ফাইটার পাইলটদের একা প্রথম ফ্লাইটে সবচেয়ে ভালো বিমানটি দেওয়া হয়। তবু কেন এমন হলো, বোঝা যাচ্ছে না।’ 

২০১৩ সালেই উৎপাদন বন্ধ এফ-৭-এর

চীনের তৈরি এফ-৭ হলো একটি হালকা ও আধুনিকায়নকৃত যুদ্ধবিমান, যা মূলত সোভিয়েত মিগ-২১-এর উন্নত সংস্করণ হিসেবে চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের নির্মিত। এফ-৭ যুদ্ধবিমান মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২১ ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত এবং ২০১৩ সালেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এই অবসরপ্রাপ্ত যুদ্ধবিমান এখনো বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে—নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা হারানো এমন একটি পুরনো জেট বিমান কেন এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে?

চীন, মিসর, আলবেনিয়া এরই মধ্যে এটি ডি-কমিশন করেছে। এটি শুধু প্রশিক্ষণ বিমান নয়, বরং একটি যুদ্ধবিমান হিসেবে তৈরি, যা জনবহুল এলাকায় ওড়ানো কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছে অনেকে। তারা বলছে, অসংখ্য দুর্ঘটনার রেকর্ড এই পুরনো বিমান দিয়ে কেন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। দাবি উঠেছে, শহরের মধ্যে থেকে বিমানবন্দর সরানোর।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘এ রকম একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহরের ওপর কেন বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান চলবে? এ ব্যাপারে নিয়মনীতি কী? নাকি যা ইচ্ছা তাই? বাচ্চাদের এই চিত্র নিতে পারছি না।’