Image description

রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এখন যেন এক বেদনার জনপদ। একের পর এক দগ্ধ কচি কচি শিশুকে নেওয়া হচ্ছে সেখানে। নিচ থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত প্রতিটি ওয়ার্ডের সামনে উদ্বিগ্ন স্বজনরা তাদের সন্তান ও ভাইবোনদের খুঁজছেন। কেউ খুঁজে পেয়েছেন, কেউ এখনো পাননি। ওয়ার্ডগুলোর সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন অভিভাবকরা।

বার্ন ইউনিটে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি মা-বাবা ও স্বজনদের আহাজারি। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সেখানে ৭০ জনকে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জানান, দগ্ধদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। এদের অবস্থা ‘ক্রিটিক্যাল’। অন্তত ২৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

গতকাল দুপুর ১টা ৬ মিনিটে বিমানটি উড্ডয়ন করার পরপরই বিধ্বস্ত হয়। এতে ১৭১ জন আহত হয়, যার মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রয়েছে ৭০ জন। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান জানিয়েছেন, ‘এ পর্যন্ত ৫৩ জনের মতো আহত ভর্তি হয়েছে। তাদের প্রায় সবাই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। সবার অবস্থা গুরুতর।’

সোমবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স এসে থামে বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে। স্ট্রেচারে করে নামানো হয় দগ্ধ শিশু-কিশোরদের। হাসপাতাল চত্বর থেকে কেবল একটি শব্দই প্রতিধ্বনিত হয়Ñ‘রক্ত লাগবে, রক্ত’। রক্ত দেওয়ার জন্য দাতাদের ভিড় জমে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের জানায়, তারা যেন নাম তালিকাভুক্ত করে রাখেন। প্রয়োজন হলে রক্তের জন্য ডাকা হবে।

গতকাল সোমবার বিকাল থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা গেছে। অ্যাম্বুলেন্স থামলেই অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে খুঁজে পাওয়ার আকুতি নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আশঙ্কাজনক অবস্থায় সন্তানকে দেখে জ্ঞান হারাচ্ছেন। মায়েরা নির্বাক। আত্মীয়স্বজনরাও বার্ন ইউনিটের সামনে। ফ্লোরে বসে পড়েছেন। বাবার চিৎকার এখনো কানে বাজছেÑ‘আমার ছেলেটা কোথায়? অ্যাম্বুলেন্সে আমার ছেলেটা আছে?’

সন্তান, নাতি, ভাই-বোনের জন্য স্বজনদের আহাজারি ও আর্তনাদে চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। অভিভাবকরা শুধু পোশাক দেখে শনাক্তের চেষ্টা করছেন। হাসপাতালের করিডোরে অসংখ্য অভিভাবক কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। কেউ চিৎকার করছেন, কেউ হতবিহ্বল।

মাইলস্টোনে ক্লাস সেভেনে পড়ে রুমেলার ছেলে। ছেলেকে আনতে মেয়ে প্রেরণা যায় স্কুলে। সেখানে গিয়ে প্রেরণা তার ভাইকে খুঁজে পায় না। মাকে ফোন করে। স্বামীহারা রুমেলা ছেলেকে খুঁজে খুঁজে দিশাহারা। এরপর বিকালে আননোন নম্বর দিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে তাকে ফোন করে জানায়, তার ছেলেটা সেখানে ভর্তি রয়েছে। রুমেলা জানান, তার ছেলে কাব্যর ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে, তবে হাত-পা বেশি জখম হয়েছে।’

সপ্তম শ্রেণিতে পড়া সামিনের ভাই কান্নারত অবস্থায় বলেন, ‘সামিনের অবস্থা খুবই খারাপ। আইসিইউতে ভর্তি আছে। ডাক্তার বলেছেন ৫০ শতাংশ, বাঁচার সম্ভাবনা আছে। এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।’

সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে রবিন হোসেন নাবিল। ডাক নাম রোহান। তার বাবা নিজাম উদ্দিন জানান, ছেলের পুরো শরীর পুড়ে গেছে। তার মা নাসিমা আক্তার কাঁদছেন আর ছেলের জন্য বিলাপ করছেন।

আইসিইউতে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ৭ শিশু, গুরুতর দগ্ধ আরো ১২

গতকাল জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডাক্তার শাওন বিন রহমান জানান, সেখানে অতিমাত্রায় দগ্ধ আছেন ১২ জন। এ ছাড়া সাতজন শিশু আইসিইউতে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দগ্ধদের সবার বয়স ৯ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে।

হাসপাতালমুখী একের পর এক, অ্যাম্বুলেন্স আসা থেমে নেই

গতকাল বেলা ২টার পর থেকে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসা শুরু হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইনস্টিটিউটে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এক ঘণ্টায় অন্তত ১৫টির বেশি অ্যাম্বুলেন্স, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে দগ্ধ রোগীকে নিয়ে ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে প্রবেশ করেছে।

নিয়মিত বিরতিতে হাসপাতালে আসা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের আওয়াজে আশপাশের এলাকা ভারী হয়ে উঠছে।

এদিকে হাসপাতালে আসার পথে অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে যেন কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে না হয়, এজন্য কয়েক শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে ঢাকা মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চাঁনখারপুল এলাকায়। তাদের পাশাপাশি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে কাজ করতে দেখা গেছে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. নাসিরউদ্দিন বিভিন্ন ইউনিটে পরিদর্শন করেন এবং রোগীর স্বজনসহ বার্ন ইউনিটের সামনে ভিড় করা লোকজনদের প্রতি আহ্বান জানান যেন তারা হাসপাতালের সামনে ভিড় না করেন।

চিকিৎসক তানভির আহমেদ বলেন, এখানে যত রোগী এসেছে তাদের মধ্যে সর্বনিম্ন রোগী রয়েছে ৩৮ শতাংশ পোড়া। এভাবে যদি এখানে লোকজন থাকে, তাদের সরানো না যায়, তাহলে রিস্ক হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, এখনো নতুন নতুন দগ্ধ রোগী আসছে এখানে। অনেক শিশুর শরীরের ৬০-৭০ ভাগ পর্যন্ত পুড়ে গেছে। তাদের বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চলছে।’

ফখরুল, রিজভী, এ্যানির বার্ন ইনস্টিটিউট পরিদর্শন

এদিকে ইনস্টিটিউটে আহতদের খোঁজ নিতে গেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। এ সময় নেতারা দগ্ধদের চিকিৎসার জন্য জরুরি ইক্যুইপমেন্ট যা যা দরকার সব ধরনের ইক্যুইপমেন্ট সরবরাহের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান।