Image description

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের হওয়া রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার কার্যক্রমে ধীরে চলছিল জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বাধীন কমিটি। অনেক জেলায় সাড়ে ৯ মাস ধরে মামলার যাচাই-বাছাই চলছিল। এ অবস্থায় নতুন নিয়োগ পাওয়া জেলা ও মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটরদের (পিপি) সরাসরি মামলা প্রত্যাহারে সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখন পিপির মাধ্যমে আবেদন পেয়ে মামলা প্রত্যাহারের সরকারি আদেশ (জিও) জারি করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে জেলা কমিটির অজান্তে অনেক মামলা প্রত্যাহার হচ্ছে। 

আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ডিসি ও পিপিরা গত সাড়ে ৯ মাসে ১৬ হাজার ৯৪০টি রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন পাঠিয়েছিলেন। পরে আইন মন্ত্রণালয় ২১টি সভা করে ১৫ হাজার ৬০০টি মামলা প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করে। এর মধ্যে ডিসিদের পাঠানো মামলার সংখ্যা প্রায় এক হাজার। বাকি ১৪ হাজার ৬০০টি মামলা পিপি ও রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করা হয়। এসব মামলার মধ্যে ১৭তম সভা পর্যন্ত জিও জারি করা হয়েছে ১১ হাজার ১৫৫টির। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারে গত ২২ সেপ্টেম্বর দুটি কমিটি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। এর একটি জেলা পর্যায়ের, অন্যটি মন্ত্রণালয়ের কমিটি। জেলা কমিটির সভাপতি ডিসি বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সদস্য সচিব অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সদস্য পুলিশ সুপার (মহানগরের জন্য পুলিশের একজন ডেপুটি কমিশনার) ও পাবলিক প্রসিকিউটর। হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য জেলা কমিটির সভাপতির কাছে আবেদনের শেষ সময় ছিল গত ৩১ ডিসেম্বর। 

জেলা কমিটির কাছ থেকে সুপারিশপ্রাপ্তির পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত ও মামলা প্রত্যাহার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল মন্ত্রণালয়ের কমিটির। সেই কমিটির সভাপতি আইন উপদেষ্টা। তবে আবেদনের শেষ সময় পর্যন্ত জেলা কমিটি থেকে মামলা প্রত্যাহারের কোনো তালিকা পায়নি মন্ত্রণালয়। সময় শেষ হওয়ার পর কয়েকজন জেলা প্রশাসক তালিকা পাঠাতে শুরু করেন। এ পরিস্থিতিতে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত আবেদনের সময় বাড়ানো হয়। হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য এখন প্রতি সপ্তাহে আইন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসছেন।

এ ব্যাপারে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হয়রানিমূলক মামলার কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী ছিলেন ঘরছাড়া। এমন নেতাকর্মীও আছেন, যার নামে শতাধিক মামলা। অন্তর্বর্তী সরকার এসব হয়রানিমূলক মামলা ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী প্রত্যাহার করছে। ডিসিদের মাধ্যমে মামলা প্রত্যাহার কার্যক্রমে দেরি হওয়ায় সলিসিটরের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। 

ডিসিদের অনীহা 
বেশির ভাগ ডিসি মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব না পাঠানোর কারণে আইন মন্ত্রণালয় সলিসিটরের মাধ্যমে প্রত্যাহারযোগ্য মামলার তালিকা সংগ্রহ শুরু করেন। সলিসিটরের কাছে যে কোনো ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল ও পিপি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার তালিকা পাঠাতে পারছেন। সে তালিকা থেকে মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হচ্ছে। 

গত ফেব্রুয়ারিতে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রথম সভায় শুধু মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা ও নড়াইল থেকে মাত্র চারটি মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব এসেছিল। দ্বিতীয় সভায় মাগুরা ও ঝিনাইদহ থেকে ৬৪টি মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন ডিসিরা। এর মধ্যে প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয় ৫৩টি। 

তৃতীয় সভায় নড়াইল ও ঝিনাইদহ থেকে ২২৩টি ও সলিসিটর থেকে ১০২৮টি মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব আসে। মন্ত্রণালয় সলিসিটরের সব মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করলেও দুই ডিসির পাঠানো ২২৩ মামলার মধ্যে সুপারিশ করা হয় ১৮৬টি। চতুর্থ সভায় শুধু নাটোর থেকে ১টি, পঞ্চম সভায় বরিশাল ও ঝিনাইদহের ছয়টি, ষষ্ঠ সভায় গোপালগঞ্জের ৭টি, সপ্তম সভায় খুলনার ছয়টি, অষ্টম সভায় চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড়ের সাতটি, নবম সভায় ঠাকুরগাঁও, ঝালকাঠি ও নড়াইলের ৭৪টি, ১০ম সভায় নোয়াখালী, ঝিনাইদহ ও পটুয়াখালীর ১৪টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়। চতুর্থ থেকে ১০ম সভা পর্যন্ত পিপিদের পাঠানো ছয় হাজার ১১৮টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে।

১১ থেকে ২১তম সভা পর্যন্ত ডিসিদের পাঠানো ৬৫০টি এবং পিপি ও রাজনৈতিক দলের প্রায় সাড়ে আট হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২১তম সভায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি ৪০৭টি মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তবে প্রস্তাবের সঙ্গে কোনো কাগজপত্র না পাঠানোর কারণে নথি আবার ফেরত পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এহসান মুরাদ সমকালকে বলেন, মামলা প্রত্যাহারের জন্য যা যা প্রয়োজন আমরা সবকিছু পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় আরও প্রমাণ চাইতে পারে। নথি ফেরত এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

আইন ও বিচার বিভাগের (সলিসিটর উইং) সলিসিটর রাফিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, মামলা যাচাই-বাছাই করে আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছি। পরে মন্ত্রণালয় প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জিও জারি করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বেশির ভাগ মামলা পিপিরা পাঠিয়েছেন। কিছু মামলার তালিকা বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম দলীয়ভাবে দিয়েছে।

ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান বলেন, ‘মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে একটা সভা হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান। শিগগির আরও একটা সভা হতে পারে। এর মধ্যে ৭ জুলাই আমার দায়িত্ব পরিবর্তন হয়ে গেছে।’

গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালমা খাতুন বলেন, মামলাগুলো ভালোভাবে যাচাইয়ের জন্য জেলা ও মহানগর পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাদের মতামত পেলে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এসব মামলা প্রত্যাহারে পুলিশের কাছ থেকে মতামত নিতে বলা হয়নি, এরপরও কেন পুলিশের কাছে পাঠিয়েছেন? এমন প্রশ্নে সালমা খাতুন বলেন, পুলিশ সদস্যরা বৈঠকে বলেছেন, মামলাগুলো পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে। এ জন্য পাঠানো হয়েছে। একইভাবে কুড়িগ্রামের ডিসি নুসরাত সুলতানা কয়েকটি মামলা পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা পুলিশের কাছে পাঠিয়েছেন। একই মামলা জেলার পিপির মাধ্যমে পেয়ে প্রত্যাহারের জিও জারি করা হয়েছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলা প্রশাসক সমকালকে বলেন, রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ আসছে। অথচ মামলাগুলো যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন।

মামলা প্রত্যাহারের আবেদন কম হওয়ার বিষয়ে নড়াইলের ডিসি শারমিন আক্তার জাহান সমকালকে বলেন, এটি গোপনীয় বিষয়, সবকিছু খোলাসা করা যাবে না। তবে জেলা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মামলা প্রত্যাহারের তালিকা পাঠানো হয়। 

নড়াইল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এস এম আবদুল হক বলেন, নাশকতা ছাড়া অন্য কোনো মামলা প্রত্যাহার হচ্ছে না। মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে ডিসি অফিসের তেমন গরজ নেই। তাই মামলা প্রত্যাহারের অগ্রগতি কম।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল সমকালকে বলেন, রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারে ডিসিদের অনাগ্রহ এক রকম প্রশাসনিক ব্যর্থতা। বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে লক্ষাধিক রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সারাদেশে এক দিনে ৪৭৩টি মামলা দেওয়া হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। এসব মামলা প্রত্যাহারে এজাহার ও অভিযোগপত্রের সার্টিফায়েড কপিসহ অনেক তথ্য-উপাত্ত লাগছে। এ জন্য সব জেলায় চিঠি পাঠানো হয়েছে।

দুদকের মামলা
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের নামে দুদকের মাধ্যমেও অনেক মামলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর আওতাধীন মামলার মধ্যে রাজনৈতিক হয়রানির মামলা কমিশনের লিখিত আদেশ ছাড়া প্রত্যাহার করা যায় না। কারণ, দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮-এর ১০(৪) ধারায় এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ধরনের মামলার বিষয়ে করণীয় পরে নির্ধারণ করা হবে।

সাবেক জেলা জজ শাহজাহান সাজু সমকালকে বলেন, দুদকের মামলা প্রত্যাহারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন। এ ছাড়া দুদক প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এর আগে ২০০৯ সালে বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগ সরকার। ওই সময় মামলার তালিকা পাঠিয়েছিলেন ডিসিরা।