Image description

সকালের আলো তখনো ফুটে ওঠেনি। সুন্দরবনের আদাচাই টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান ও তাঁর দল হেঁটে যাচ্ছিলেন বনের ভেতর দিয়ে। হঠাৎ কচুখালী সিসা খালের পাশে থমকে দাঁড়ান তাঁরা। ভেজা পাতার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসে শুঁটকি মাছের গন্ধ। পাশে গাছের ভাঙা ডাল ও পায়ের ছাপ দেখে নিশ্চিত হন, কেউ ছিল এখানে। আরও এগিয়ে গিয়ে গহিন বনে পান ১৮ বস্তা বিষ দিয়ে ধরা চিংড়ির শুঁটকি। মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পায়ের ছাপ দেখেই বুঝেছিলাম, কেউ আছে। কিন্তু আমরা পৌঁছানোর আগেই ওরা পালিয়ে যায়। প্রায়ই এমন হয়।’

ঘটনাটি ঘটেছে গত মঙ্গলবার সকালে। এর তিন দিন আগে চাঁদপাই রেঞ্জের বনরক্ষীরা বড় ডাবুর খাল থেকে দুই ট্রলারভর্তি আরও ১৮ বস্তা শুঁটকি জব্দ করেন।

চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক দীপক চন্দ্র দাস বলেন, কিছু অসাধু জেলে সুন্দরবনের গহিনে কীটনাশক ছিটিয়ে চিংড়ি ধরেন। পরে গাছ কেটে আগুনে শুকিয়ে বানান শুঁটকি।

বিষ দিয়ে মাছ ধরার অপরাধে জেল খেটে আসা এক জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বনের মধ্যে জোয়ারের পানিতে খাল ভরে উঠলে দুই প্রান্তে ছোট ফাঁসযুক্ত ভেশালি দিয়ে ফাঁদ পাতা হয়। এরপর ভাটার টানে পানি নামতে শুরু করলে ওই ফাঁদের মধ্যে কীটনাশক ঢেলে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে চিংড়ি ভেসে ওঠে, সেগুলোই ধরা হয়। এরপর সুন্দরবনের মধ্যে গাছ কেটে তৈরি করা হয় ফাঁকা জায়গা। সেখানে কেটে রাখা সুন্দরী, পশুর, গেওয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ সাজিয়ে বিশেষ কায়দায় বানানো হয় মাচা। এসব মাচার ওপর চাটাই বিছিয়ে তার ওপর চিংড়ি রেখে নিচে কাঠ পুড়িয়ে আগুন দেওয়া হয়। আগুনের তাপে বিষ দিয়ে ধরা চিংড়ি শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুঁটকি। পরে তা বস্তায় ভরে নদীপথে শহরে চলে যায়।

বন বিভাগ জানায়, ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে মাছ ধরা, কাঁকড়া আহরণ ও পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ। এ মৌসুমে মাছ ও বন্য প্রাণীর প্রজনন নিশ্চিত করতে এ বিধিনিষেধ। তবু সবচেয়ে বেশি চিংড়ি শিকার হয় এ সময়েই।

খাশিটানা টহল ফাঁড়ির বনরক্ষী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘৯ জুলাই ভোরে ছেঁড়া নদীর বাওন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিষ দিয়ে ধরা ৮০ কেজি চিংড়ি, ১টি নৌকা ও ২ বোতল কীটনাশক জব্দ করি। কিন্তু অপরাধীরা পালিয়ে যায়।’

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৯৭৫টি হরিণ শিকারের ফাঁদ, ৪০ বোতল কীটনাশক, ৩২টি নৌকা ও ৫টি ট্রলার জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪৭ জন। তবে অধিকাংশ অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

কয়রার বনসংলগ্ন গ্রামগুলোয় গিয়ে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিষ দিয়ে ধরা চিংড়ি সরাসরি লোকালয়ে আনা হয় না, পাইকারি বাজার ও খোলাবাজারে বিক্রি হয় না। তাই জেলেরা বনের গভীরে মাচা বানিয়ে চিংড়ি শুকিয়ে তবেই পাচার করেন। সুন্দরীগাছের কাঠে আগুন দিলে শুঁটকি লালচে হয়, বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়। এ কারণে সুন্দরীগাছই বেশি কাটা হচ্ছে। একসময় কয়রার লোকালয়েও এমন শুঁটকির কারখানা ছিল। বন বিভাগ ও প্রশাসনের যৌথ অভিযানে কয়েক বছরে অন্তত ৩০টি কারখানা ধ্বংসের পর কারবারটি এখন পুরোপুরি বনের গভীরে চলে গেছে।

১৮ বস্তা শুঁটকি জব্দ করেন বন কর্মকর্তারা। সম্প্রতি তোলা
১৮ বস্তা শুঁটকি জব্দ করেন বন কর্মকর্তারা। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

কয়েকজন জেলের ভাষ্য, ভারতের হেমনগর ও কলকাতা বন্দর থেকে আসা ছোট জাহাজগুলোই সুন্দরবনের বিষশুঁটকি পাচারের গোপন মাধ্যম। কয়রার আংটিহারা শুল্ক অফিস হয়ে এসব জাহাজে গোপনে শুঁটকি তুলে দেওয়া হয়। গত বছর শিবসা নদীতে একটি জাহাজ থামিয়ে বনরক্ষীরা ৩০০ কেজি শুঁটকি ও দুই পাচারকারীকে হাতে নাতে ধরেন।

ধরা পড়া এক জেলে আবু বাক্কার সানা বলেন, ‘বন্ধ মৌসুমে বনের মধ্যি গাছ কাইটে মাচা বানায়ি তার ওপরে চিংড়ির শুঁটকি বানাতাম। পরে সেই শুঁটকি জাহাজে তুইলি ডাঙায় যাইত। আমি গত বছর ধরা খাইছি, তাই এবার আর যাইনি। আমাগের শত্রুতা করি ধরাই দিছিল আরেক দল, তবে ওরা ধরা খায়নি। এক চালানের মাল ধরছে, বাকি তো ধরতি পারে নাই। যারা বনের মধ্যি শুঁটকি বানায়, তারা মাছ শুকাইয়ে বস্তায় ভইরে আরেক জায়গায় লুকাই রাখে। বন বিভাগের লোকজন মাছের বস্তা পায় তো মাচা পায় না, আবার মাচা পায় তো মাছের বস্তা পায় না।’

কয়রার মহেশ্বরীপুরের বনজীবী জেলে ভবতোষ কুমার বলেন, বন্ধ মৌসুমে সুন্দরবনে যে পরিমাণ বিষ ছিটানো হয়, সারা বছরেও বনের এতটা ক্ষতি হয় না। এ সময়ে কোনো জেলেরই পাস মেলে না, শুধু অপরাধীরা গোপনে গহিন বনে ঢুকে বিষ ছিটিয়ে চিংড়ি ধরে। সেই চিংড়ি লোকালয়ে আনা যায় না বলে বনের ভেতরেই মাচা বানিয়ে আগুনে শুকিয়ে শুঁটকি করে চুপিচুপি শহরে পৌঁছে দেয়।

সুন্দরবন ও উপকূল সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বিষ দিয়ে ধরা মাছ খেয়ে বন্য প্রাণী মারা যাচ্ছে, মানুষের শরীরেও এর প্রভাব পড়ছে। প্রতিবছর কিছু অপরাধী ধরা পড়লেও মূল চক্রটি রয়ে যাচ্ছে অক্ষত। এর পেছনে টাকা, প্রভাব আর দায়মুক্তির চুক্তি কাজ করে।

সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘এবার বন্ধ মৌসুমে আমরা অপরাধীদের স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছি না। অপরাধ দমনে স্মার্ট টহল টিমের সঙ্গে বিশেষ টিমও হেঁটে টহল জোরদার করেছে। তাই হরিণ শিকারের ফাঁদ আর শুঁটকি মাচা বেশি ধ্বংস হচ্ছে। তবে গহিন বনে বিষ দিয়ে চিংড়ি ধরা আর মাচা বানানো খুবই উদ্বেগজনক। এতে বন ও জীববৈচিত্র্য—দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। টহল বোটের শব্দ পেলেই অপরাধীরা পালিয়ে যায়, আবার জনবলও কম। তারপরও সাধ্যের মধ্যে প্রতিটি অপরাধে ব্যবস্থা হচ্ছে, তালিকাও হচ্ছে। আর দায়িত্বে গাফিলতি প্রমাণিত হলে বনকর্মীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’