Image description

‘আহাদ দৈনিক দু-চার বার ফোন দিত। আর বলত—বাবা, তাড়াতাড়ি আইসো। এ কথা পাঁচ-ছয়বার বলত। এখন আর কেউ তাড়াতাড়ি আসতে বলে না।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ চার বছরের শিশু আব্দুল আহাদের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এসব কথা বলেন তার বাবা মো. আবুল হাসান। তিনি সরকারের আয়কর বিভাগে আছেন। রাজধানীর মিরপুরে সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে সপরিবারে থাকেন। তাঁদের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামে।

এই গ্রামের মাটিতেই এখন চিরঘুমে আছে শহীদ আহাদ।

আহাদের মা কোহিনূর আক্তার গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে আহাদ ছিল ছোট। বড় ভাই মেহেরাজ হাসান দিহান (১৩) মাদরাসায় পড়ে।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগের বি ব্লকের মেরাজনগর তিন রাস্তার মোড়ে একটি ১১ তলা ভবনের অষ্টম তলায় ভাড়া থাকত শহীদ আহাদের পরিবার। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই এই বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয় চার বছরের শিশু আব্দুল আহাদ।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আবুল হাসান। তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজ শেষ করে বাসায় এসে দেখি আব্দুল আহাদ ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ করে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বাসার নিচে ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি আর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়।

খুব আওয়াজ হচ্ছিল। আমি জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলাম, দুটি গ্রুপ ইটপাটকেল ছুড়ছে আর দেশি অস্ত্র দিয়ে একে অপরকে ধাওয়া করছে। আমার বাসা থেকে কদমতলী থানা ২০০ থেকে ২৫০ মিটার দূরে। সেখান থেকে মাঝেমধ্যে দু-একটি সাউন্ড গ্রেনেড মারছিল। ওই আওয়াজে আহাদের ঘুম ভেঙে যায়। ও সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে বলে, বাবা দেখো নিচে মারামারি হচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসো। তারপর আমরা প্রায় এক ঘণ্টার মতো বারান্দায় ছিলাম। আমার আর আমার স্ত্রীর মাঝখানে আহাদ ছিল। সাড়ে ৪টার দিকে নিচ থেকে একটি গুলি আসে। গুলি এসে ঠিক আহাদের ডান চোখের ওপরের দিকে লাগে। আসলে তখন আমরা বুঝতে পারিনি গুলি লেগেছে। গুলি লাগা মাত্র ও পেছন দিকে ঘুরে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমি যখন ওকে ধরতে গেলাম, তখন আমার হাত রক্তে ভরে গেল। দেখলাম, ওই স্থান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, মাংসও বের হয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি ওকে কোলে নিয়ে নিচে নামলাম। আমার বিল্ডিংয়ের দুই পাশে দুই গ্রুপ অবস্থান করছিল। আমি ওকে নিয়ে বের হতে পারছিলাম না।’

 

চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘পরে আমি একটি গ্রুপকে খুব কান্নাকাটি করে বুঝাচ্ছিলাম যে আমার ছেলের গুলি লেগেছে, ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। তখন ছাত্ররা আওয়ামী লীগের গ্রুপকে ইশারা করল যে উনাকে যেতে দাও। তখনো মারামারি চলছে। এর মধ্যেই আমি দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। এরপর একটি অটোরিকশায় করে যাত্রাবাড়ীর দোলাইরপাড়ে এলাম। তখন অনেকে বিভিন্ন জায়গায় বাধা দিচ্ছিল। অনেক কান্নাকাটি করার পর যেতে দিয়েছে। ওখান থেকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় করে ওকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে চলে এলাম।’

তিনি বলেন, ‘তারা ওকে দেখে আইসিইউতে নিয়ে গেল। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখল। ১৯ তারিখ রাতে আহাদের মাথার এক্স-রে করা হলো। দেখা গেল, গুলিটা পিছন সাইডে আটকে আছে। মাথার ওই জায়গা ফুলে আছে। এরপর ২০ জুলাই রাত ৯টার দিকে আহাদ শহীদ হয়।’

অনেক চেষ্টা করেও শহীদ আহাদের ময়নাতদন্ত আটকাতে পারেননি আবুল হাসান। সেই কষ্ট বাবার বুকে এখনো জেঁকে বসে আছে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমরা ঢাকা মেডিক্যালের ডাক্তারদের অনেক অনুরোধ করেছিলাম যে ও ছোট মানুষ, ওর ময়নাতদন্ত যেন না হয়। ওই সময় আমাদের বলল যে আপনারা থানায় যান। থানায় গিয়ে পুলিশের অনুমতি নিয়ে আসুন। আমরা ওখান থেকে রাত সাড়ে ১২টার দিকে একটা সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে কদমতলী থানায় গেলাম। ওই সময় অনেক বাধা পেয়েছি। অনেক কান্নাকাটি করেছি। হাতে-পায়ে ধরেছি। তারা আমাদের শাহবাগ থানায় যেতে বলল। সেখান থেকে আবার শাহবাগ থানায় গেলাম। তারা বলল যে ওপর থেকে নির্দেশ আছে, ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দিতে পারব না। ২১ তারিখ সকাল ১০টার দিকে আমরা ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে নিয়ে আসি। সেখান থেকে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আহাদের লাশ পাই। তারপর আমরা একটা অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে যাই। সেখানে আহাদের দাফন সম্পন্ন করি।’

শহীদ হওয়ার আট দিন আগে ছিল শিশু আহাদের চতুর্থ জন্মবার্ষিকী। সেই স্মৃতি স্মরণ করে আবুল হাসান বলেন, “আহাদ ছিল খুবই চঞ্চল প্রকৃতির। বাসায় সারা দিন ওর আম্মুর সঙ্গে থাকত। ওর নামে ফেসবুকে একটা পেজও ছিল। আহাদের দুষ্টামিগুলোর ভিডিও ওর আম্মু ওই পেজে রাখত। আহাদ যে মারা গেছে, ওর এই শূন্যতা বলে বোঝানো সম্ভব না। আমি অফিসে থাকলে ও আমাকে ফোন দিয়ে বলত, ‘বাবা, আমার জন্য চিকেন নিয়ে আইসো, ফ্রেন্স ফ্রাই নিয়ে আসবা, চাওমিন নিয়ে আসবা।’ এই তিনটি জিনিস খুব পছন্দ করত। একজন শহীদের বাবা হিসেবে আমার চাওয়া—বাংলাদেশে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আর যেন না ঘটে। আর কখনো কাউকে যেন এ রকম সন্তান হারাতে না হয়।’