Image description
পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনা » ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য চাপ তৈরির অস্ত্র পাল্টা শুল্ক । » যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী দেশগুলোর সম্পর্কে প্রভাব পড়ার ঝুঁকি । » দর - কষাকষিতে লুকোচুরির অভিযোগ ।

রপ্তানি পণ্যে আরোপ করা পাল্টা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চলছে বাংলাদেশের । এই আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের দিকগুলো বড় আকারে সামনে এলেও বিষয়টিকে দেশটি ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য চাপ তৈরির একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলে পর্যবেক্ষণ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্লেষকদের ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন , বাংলাদেশের জন্য মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব , এটা বুঝেই যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানির ক্ষেত্রে পাল্টা শুল্কের নামে ৩৭ শতাংশ সম্পূর্ণ নতুন শুল্ক আরোপের কথা জানায় । এই প্রস্তাবকে বড় মনস্তাত্ত্বিক চাপ হিসেবে দেখছেন তাঁরা । মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসকে দেওয়া চিঠিতে পাল্টা শুল্কের বিষয়টি জানান ।

একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন , একটি দেশের সরকারপ্রধানকে প্রেসিডেন্টের লেখা চিঠি হোয়াইট হাউস সামাজিক মাধ্যমে দিয়ে দিচ্ছে । এতে ট্রাম্প মার্কিন সমাজে প্রশংসিত হলেও যে দেশের জন্য শুল্কের প্রস্তাব করা হয়েছে , সেখানে মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক চাপ তৈরি হচ্ছে । পাল্টা শুল্ক নিয়ে দর - কষাকষির ভিত্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) ২১ মের চিঠির ছত্রে ছত্রে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে , তাতেও নানামুখী চাপ তৈরির উপকরণ দেখছেন বিশ্লেষকেরা । যুক্তরাষ্ট্রের শর্তে বাণিজ্য , জাতীয় নিরাপত্তা , ডিজিটাল প্রযুক্তি , বিভিন্ন পণ্য এবং সেবার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মান ও সনদ বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া, কিছু ক্ষেত্রে আমদানির অনুমতি চাওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি , মার্কিন ব্যবসায়ীদের চাহিদামতো অনাপত্তিপত্র দেওয়ার বাধ্যবাধকতা চালু করাসহ এমন অনেক বিষয় আছে , যেগুলো অনেক দেশের জন্যই মেনে নেওয়া কঠিন ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন , যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সামরিক যন্ত্রপাতি , উড়োজাহাজ , জ্বালানি ও ভোজ্যতেল , গম বিক্রি ব্যাপকভাবে বাড়াতে চায় । এটা তারা চাইতেই পারে । কিন্তু একই সঙ্গে চীনসহ অন্য দেশ থেকে একই পণ্য আমদানি কমানোর দাবি ; যুক্তরাষ্ট্রকে যে পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়া হবে, একই পণ্যে অন্য দেশকে শুল্কছাড় না দেওয়ার শর্ত; যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশের বন্দর, জেটি ও জাহাজে চীনের তৈরি বিশেষ ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা; বিভিন্ন ব্যবসা ও পেশার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ প্রস্তাব; অনেক ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানির তথ্য মার্কিন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া , যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি সই করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে (ডব্লিউটিও) জানানোসহ বহু শর্ত দিয়েছে দেশটি ।

 শুল্ক নিয়ে আলোচনার মাঝপথে প্রধান উপদেষ্টাকে ফোন করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও । তিনি শুল্কের আলোচনায় গতি আনা এবং বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত গণতন্ত্রে ফেরার তাগিদ দেন । এসবের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সংলাপসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মিয়ানমারের রাখাইনের সঙ্গে স্থল অথবা জলপথে ‘ মানবিক চ্যানেল ’ চালু করাসহ কৌশলগত স্বার্থের নানা দিকও টেনে আনছেন মার্কিন কর্মকর্তারা ।

যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে ‘ চাপ ' তৈরির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় দেশটির দূতাবাসের মুখপাত্র আজকের পত্রিকাকে বুধবার বলেন , ‘ চলমান দ্বিপক্ষীয় দর - কষাকষির বিষয়ে দূতাবাস কোনো মন্তব্য করে না । ’

কী চায় যুক্তরাষ্ট্র

সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী , যুক্তরাষ্ট্র শুল্কের বিষয়টি সামনে রেখে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের নামে একটি ব্যাপকভিত্তিক কাঠামোগত চুক্তি চায় । এর মাধ্যমে নিজের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি এমন একটি ব্যবস্থা চালু করতে চায় , যার মাধ্যমে দেশটি অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও আমদানি - রপ্তানি প্রবাহ এবং কৌশলগত কেনাকাটার ওপর নজরদারি করার সুযোগ পেতে পারে । এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বভৌম এখতিয়ার লঙ্ঘনের ঝুঁকি দেখছেন স্থানীয় বিশ্লেষকেরা ।

তাঁরা বলছেন, কাঠামোগত চুক্তিতে এমন ধারা যুক্ত হলে দেশটি ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী মনোভাব আছে , এমন দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা- বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের ওপর দেশটি ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণ আরোপের সুযোগ নিতে পারে । এতে চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে । আলোচনায় লুকোচুরির অভিযোগ অংশীজন, বিশ্লেষক এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের অভিযোগ , যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন একটি বহুমুখী , গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কূটনৈতিক বিষয়কে শুরুতে আর দশটি সাধারণ আন্তর্জাতিক বিষয়ের মতো সামাল দিতে চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের জটিল বাণিজ্যিক বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় দর - কষাকষির মূল দায়িত্ব থাকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের ওপর ; আর রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক দেখে থাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় । কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় শুরুতে এ দুটি মন্ত্রণালয়কেই ' পাল্টা শুল্কের ’ আলোচনা থেকে দূরে রাখে । সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়াই এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে যান প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকী । তাঁর নেতৃত্বে মার্কিনদের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিনসহ অন্যরা । এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার গোপনীয়তা বজায় রাখতে“ নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এনডিএ) সইয়ের জন্য চাপ দেয় । এনডিএ সই হয় ১২ জুন । কিন্তু পাল্টা শুল্কের আলোচনা কিছুতেই না এগোনোয় অবস্থা বেগতিক দেখে এই প্রক্রিয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করা হয় ট্রাম্পের চিঠি আসার আড়াই মাস পর । ইউএসটিআর প্রথমবারের মতো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অনলাইনে সভা করে ১৭ জুন । কিন্তু ২৬ জুন জুন ওয়াশিংটনে মুখোমুখি আলোচনার বিষয়টি সামনে এলে পাঠানো হয় প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড . খলিলুর রহমানকে ।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও গত ৩০ জুন মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে বাণিজ্যের আলোচনায় গতি আনার তাগিদ দেন । পাশাপাশি বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরার ওপরও তিনি জোর দেন । বর্তমান স্থানীয় রাজনৈতিক বাস্তবতায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনার সঙ্গে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ যুক্ত করাকে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ হিসেবে দেখছেন কূটনীতিকেরা । রুবিওর তাগিদের পর ৩ জুলাই খলিলুর রহমানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বৈঠকে যোগ দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ।

খলিলুর রহমান আলোচনা ‘ভালোভাবে’ এগোনোর দাবি করলেও বিষয়টি যে আসলে তেমন ছিল না , তা স্পষ্ট হয়ে যায় তিনি ওয়াশিংটনে থাকা অবস্থায়ই মুহাম্মদ ইউনূসকে দেওয়া ট্রাম্পের দ্বিতীয় চিঠিতে । ৮ জুলাইয়ের এই চিঠিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্তমানে কার্যকর ( ১৫ শতাংশ ) শুল্কের অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আগামী ১ আগস্ট থেকে আরোপ করার কথা জানান ট্রাম্প ।

এরপর ৯ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিক আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন । তবে বহুমুখী এই দর - কষাকষির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য , বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষের মতামত নেওয়া এবং অংশীজনদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মারাত্মক ঘাটতির মুখে বাণিজ্য উপদেষ্টাকে আলোচনা অসমাপ্ত রেখে পরামর্শের জন্য ঢাকায় ফিরে আসতে হয় । যুক্তরাষ্ট্রের তোলা বিভিন্ন বিষয়ে সবার সঙ্গে আলোচনার পর দেশের একটি ‘অবস্থানপত্র’ আগামী সপ্তাহের শুরুতে তৈরি করার কথা বলছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা । এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তৃতীয় দফা বৈঠকের সম্মতি মিললে তাঁর আগামী সপ্তাহেই সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে । বাংলাদেশ চায় চলতি জুলাইয়ের মধ্যে বিষয়টির ফয়সালা করতে ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গত মঙ্গলবারের পরামর্শমূলক সভায় যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড . সেলিম রায়হান । তিনি বলেন , এনডিএর অজুহাত দেখিয়ে অংশীজনসহ কারও সঙ্গে কথা না বলে সরকার দুই দফা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেছে । এখন তৃতীয় দফা বৈঠকের আগে পরামর্শের জন্য সভা ডাকা হলেও খোলাখুলি বলছে না , তাদের কোন বিষয়ে কী ধরনের পরামর্শ দরকার ।

এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের ধারণা করে কথা বলতে হচ্ছে । আলোচনায় বাংলাদেশের মৌলিক নীতিগত অবস্থান কী , এমন প্রশ্নে এক সরকারি কর্মকর্তা বাণিজ্য উপদেষ্টার একটি মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন । উপদেষ্টা বলেন , “আমি নত হতে রাজি । কিন্তু কতটা নত হলে ভেঙে পড়ব না , সেটা তো বুঝতে হবে ।” যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা পণ্যে বাংলাদেশ বর্তমানে গড়ে ৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে । এই শুল্ক প্রায় পুরোপুরি তুলে দেওয়া হতে পারে । সরকারের হিসাব অনুযায়ী , যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কছাড় দেওয়া হলে রাজস্ব যে পরিমাণ কমবে , তার চেয়ে ‘ পাল্টা শুল্ক ' অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে এনে দেশটিতে বাজার ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ । এর বাইরে সরকারিভাবে গম , তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ( এলএনজি ) , উড়োজাহাজ ও এর যন্ত্রাংশ , ভোজ্যতেল এবং তুলা আমদানি বাড়ানোর কথা বিবেচনা করছে সরকার ।

প্রতিনিধিদলের

বাংলাদেশ একজন সদস্য আজকের পত্রিকাকে বলেন , ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনায় উভয় পক্ষ একমত হলেও সেটাই চূড়ান্ত ধরে নেওয়ার সুযোগ সম্ভবত নেই । বিষয়টি হোয়াইট হাউসে যাবে । প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঠিক করবেন , বাংলাদেশের জন্য ‘ চূড়ান্ত পাল্টা শুল্ক ’ ঠিক কত হবে ।

টার্গেট চীন

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির আজকের পত্রিকাকে বলেন , যুক্তরাষ্ট্র কী উদ্দেশ্যে এত দেশের সঙ্গে শুল্ক - যুদ্ধ শুরু করেছে , এর কৌশলগত দিকগুলো কী , সম্ভবত অন্তর্বর্তী সরকার তা শুরুতে ধরতে পারেনি । ট্রাম্প শুল্ক বাড়িয়ে নিজ দেশের আয় বাড়ানোর কথা বললেও আসলে তারা আরও দুটি উদ্দেশ্য আছে — প্রথমত , বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ( ডব্লিউটিও ) ভিত্তিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দেওয়া । এতে ট্রাম্প নিজের শর্তে বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে নাজুক অবস্থানে থাকা দেশগুলোসহ পুরো বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেখছেন ।

চলমান আলোচনায় লিখিতভাবে দেওয়া যেসব প্রস্তাব নিয়ে কথা হচ্ছে, সেগুলোর বাইরেও ডালপালা ছড়াতে পারে, এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির বলেন , রুলস অব অরিজিনে যুক্তরাষ্ট্রমুখী পণ্যে বাংলাদেশে 80 শতাংশ মূল্য সংযোজনের যে শর্ত দেওয়া হয়েছে , তা চীনকে আটকানোর একটি উপায় । একই উপায়ে অনেকগুলো দেশে চীনের রপ্তানিতে লাগাম টেনে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করা গেলে যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কৌশলগত দিক থেকেও দীর্ঘমেয়াদি নানা রকম সুবিধা পেতে পারে ।

সাবেক এই কূটনীতিক আরও বলেন , যুক্তরাষ্ট্র এবারকার আলোচনায় যেসব বিষয় তুলছে , সেগুলোতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কার , শ্রমমান , মৌলিক অধিকার রক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা দরকার হতে পারে । এমন ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তুতি ও শক্তি — কোনোটাই দেশের নেই । তিনি বলেন , “ অন্তত আগামী ২০ বছরের মধ্যে পরিবর্তন আনার একটি বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা এবং পথরেখা দেওয়া গেলে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা সুযোগ দেবে । কিন্তু সরকারের মেয়াদ আছে আর মাত্র কয়েক মাস । এই নিশ্চয়তা কে দেবে ? '

আলোচনার শুরুতে বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দূরে রাখা প্রসঙ্গে হুমায়ুন কবির সরকারের কাজকর্মে কৌশলগত স্বচ্ছতার অভাবের কথা বলেন । দুই মন্ত্রণালয়কে দূরে রাখা “ মারাত্মক ভুল ' হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন , নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আসার কথা । কিন্তু সরকার তাদের সঙ্গেও পরামর্শ করা দরকার মনে করছে না । এতে বড় ধরনের তালগোল পাকিয়ে ফেলার ঝুঁকি আছে । ’ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর - কষাকষিতে সুবিধা পাওয়ার মতো বড় কোনো উপায় ( লিভারেজ ) হাতে না থাকায় আলোচনায় শেষ পর্যন্ত কী মিলবে , সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখছেন বিশ্লেষকেরা । প্রস্তুতির ঘাটতি থাকায় এ ক্ষেত্রে কিছুটা ‘ ভাগ্যের ’ ওপর নির্ভর করতে হতে পারে , এমনটা মনে করছেন তাঁরা ।

দীর্ঘ মেয়াদে বিপুল নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা স্থানীয় বিশ্লেষকেরা বলছেন , প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘ পাল্টা শুল্কের বিষয়ে যে সিদ্ধান্তই নিন না কেন , তা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিকসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বড় রকম প্রভাব ফেলতে পারে । বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শুল্ক ভিয়েতনাম ( ২০ শতাংশ ) , ইন্দোনেশিয়া ( ১৯ শতাংশ ) এবং ভারতের মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি হলে এখানে রপ্তানি আয় বেশ কমতে পারে ।

বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট মাহমুদুল হাসান খান ও স্থানীয় বিশ্লেষকেরা বলছেন , যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান আলোচনায় ভালো ফল না এলে দেশের পুরো অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি আছে । অনেক শিল্প - কারখানা বন্ধ হয়ে বহু শ্রমিকের বেকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে । এর পরিণতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ নানা রকম সামাজিক সমস্যা দেখা দিতে পারে । ভারতের সঙ্গে একই বিষয়ে ভূরাজনৈতিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা চলছে । চীনের সঙ্গে দুই দেশেরই বৈরিতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের জন্য পাল্টা শুল্কের যে হার ঠিক করবে বাংলাদেশের হার তার চেয়ে বেশি হলে স্থানীয় শিল্প ও রপ্তানি বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে । ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন গত বুধবার বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন । দেশটির দূতাবাসের ফেসবুক পোস্ট অনুযায়ী তাঁদের আলোচনার প্রসঙ্গ ছিল দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য , বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ও আনুষঙ্গিক বিষয় । জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী , ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে । রপ্তানি করেছে ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য ।