
জাতীয় মহিলা সংস্থায় সিলেকশন গ্রেড প্রদান ও বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি, বৈষম্য ও বিধি লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এমনকি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় সংস্থাটির অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বছরের পর বছর ধরে তাদের ন্যায্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। এছাড়া সরকারি নির্দেশনা অনুসারে গ্রেড ধরে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য পৃথক কমিটি গঠনের কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। সিলেকশন গ্রেড ও বকেয়া বিল অনুমোদনে আছে চরম বৈষম্য। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের আদেশও উপেক্ষা করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক গোপন তদন্তে এসব তথ্য পাওয়ার পর প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিয়েছে এনফোর্সমেন্ট টিম। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গত ৩ ফেব্রুয়ারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাওনা প্রদানে দুর্নীতি ও হয়রানিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে জাতীয় মহিলা সংস্থায় অভিযান চালায় দুদক। এতে দুর্নীতি-হয়রানির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। সম্প্রতি দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম মহিলা সংস্থার নথিপত্র যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেয়। যেখানে অনিয়মের বিষয়টি প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সুপারিশ করা হয়।
জানতে চাইলে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযানের পর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই সুপারিশ আমলে নিয়েই কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হবে না। টিমের সুপারিশের আলোকেই পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে জাতীয় মহিলা সংস্থার বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহানা শারমিন বলেন, এখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। অবসরে যাওয়া মানুষের পাওনা পাওয়া উচিত। এটা মানবিক বিষয়। আমি এসেই চেষ্টা করেছি। আমাদের সচিবও বিষয়টি অবগত। আমি গুছিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। অর্থ মন্ত্রণালয়ে টাকা না দিলে তো দিতে পারব না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুদকের পক্ষ থেকে যারা এসেছিলেন, তারা কিছু তথ্য- উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। তবে তাদের প্রতিবেদন সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দিলীপ কুমার দেবনাথের কাছে মহিলা সংস্থার চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাতীয় মহিলা সংস্থা থেকে বেতন-ভাতার বিষয়ে চিঠি আমরা পেয়েছি। মহিলা সংস্থা যে চিঠি দিয়েছে, সেখানে একটু সমস্যা আছে। তারা আসলে কী চায় সে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। একবার বলে মতামত, আবার বলে ফান্ড নেই। তারা সরাসরি কিছু বলছে না। ফান্ড না থাকলে অর্থ মন্ত্রণালয়ে লিখলেই তো হলো। এখানে মারপ্যাঁচ থাকা উচিত নয়। আমি চাই অবসরে যারা গেছেন তারা তাদের প্রাপ্য পাক। এটা মানবিক বিষয়।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি বিধি অনুযায়ী সঠিক কমিটি গঠন করে পদোন্নতি ও অর্থ প্রদানে অনিয়মের বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে প্রকাশ্য অনুসন্ধান প্রয়োজন। মহিলা সংস্থায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান ও ‘গ্রামীণ মহিলা উন্নয়ন’ প্রকল্পের তিন কর্মকর্তার সিলেকশন গ্রেড ও বকেয়া প্রদানে বৈষম্য এবং পদোন্নতিতে সরকারি বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রকাশ্য অনুসন্ধান হতে পারে।
রেকর্ডপত্র অনুযায়ী, মো. মনিরুজ্জামান ১৯৯৭ সালে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পান এবং ২০২০ সালে চাকরি স্থায়ী হয়। পরে সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল সম্পন্ন করে তার মোট বকেয়া ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪০৭ টাকা নির্ধারিত হয়, যা তিনি ২০২৪ সালের জুনে উত্তোলন করেন। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য কর্মীরা বকেয়া পাননি, যা ইচ্ছাকৃত কালক্ষেপণ বলেই মনে করেন। যদিও তার বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সহকর্মীদের।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই সময়ে গ্রামীণ মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পের তিন কর্মকর্তা পারভীন লায়লা, আফরোজা বেগম এবং একেএম ইয়াহিয়া হাইকোর্টের আদেশে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের বকেয়া বিল এখনো অনুমোদন হয়নি। মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক থেকে শুরু করে পরিচালক ও উপপরিচালকরা নোটে ‘আলোচনা প্রয়োজন’, ‘বকেয়া পুনঃহিসাব করুন’, ‘বিধি অনুযায়ী যাচাই করুন’-এমন মন্তব্য করে বারবার ফাইল ফেরত দিয়েছেন। পদোন্নতি ও টাইমস্কেল প্রদানসংক্রান্ত সরকারি বিধি অনুযায়ী যথাযথ কমিটি গঠিত হয়নি বলেও এনফোর্সমেন্ট টিমের অনুসন্ধানে উঠে আসে।
সরকারি বিধি অনুযায়ী, ৭ম, ৮ম ও ৯ম গ্রেডভুক্ত ১ম শ্রেণির এবং ১০ম-১২শ গ্রেডভুক্ত ২য় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তাদের জন্য পৃথক পদোন্নতি ও টাইমস্কেল কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে, জাতীয় মহিলা সংস্থায় ১ম ও ২য় শ্রেণির জন্য একটি অভিন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট উপপরিচালক এনফোর্সমেন্ট টিমের কাছে স্বীকার করেছেন যে, অভিযোগে উল্লিখিত নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে সঠিক বিধি অনুযায়ী কমিটি গঠন করা হয়নি। এতে পদোন্নতি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।