Image description

অতীতে এডিস মশার সংক্রমণে সৃষ্ট ডেঙ্গু জ্বর কেবল শহরাঞ্চলে বেশি দেখা গেলেও; গত কয়েক বছর ধরে তা শহর-গ্রাম, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্যাপক হারে ছড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পিত পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম না থাকায় এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। বর্তমানে দেশের চার জেলা গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, জয়পুরহাট এবং সুনামগঞ্জ বাদে বাকি ৬০ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। এখন পর্যন্ত এই চার জেলায় কোনো ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়নি। তবে বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে দেশের ১০ জেলায়। এর মধ্যে পাঁচটি উপকূলীয় জেলা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে পরিকল্পিত কোনো পরিচ্ছন্নতা অভিযান নেই। ফলে ডেঙ্গু মশার বিস্তার কমার কোনো আশা নেই। 

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ৫২৬ নম্বর ওয়ার্ডে মেডিসিন বিভাগের ৩৮ নম্বর বেড়ে ভর্তি সুজন খান-(৩০)। তিনি পেশায় একজন ইলেকট্রিশিয়ান। চার দিন ধরে জ্বর আর শরীরের সব গিঁটে ব্যথা, চোখ লাল হয়ে আছে, সঙ্গে আছে বমি ভাব ও প্রচণ্ড দুর্বলতা। সুজন খান বয়সে তরুণ হলেও তিনি নিজে কিছুই করতে পারছেন না, পাশে থেকে সুজনের কাকা মো. মঞ্জু আলম তার দেখভাল করছেন। সুজন খানের গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার বেতাগী থানায়। বর্তমাতে তিনি থাকছেন মিরপুর-১এ। রবিবার সকালে ভর্তি হন হাসপাতালে। পরীক্ষার পর জানতে পারেন সুজন খান ডেঙ্গু আক্রান্ত।

হাসপাতালটির একই ওয়ার্ডের ২৩ নম্বর বিছানায় আছে ১৩ বছরের মাহিম হোসেন। সপ্তম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী ডেঙ্গু শনাক্তের পর নরসিংদী থেকে এসে ভর্তি হয়েছে গত চার দিন আগে। সঙ্গে থাকা মাহিমের মা মুসলিমা সুলতানা জানান, তারা রাজধানীর কল্যাণপুরে বেড়াতে এসেছিলেন, সেখান থেকে নরসিংদী ফেরার দুদিন পর তার জ্বর আসে। ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিত্সক জানান, শিশুটি আশঙ্কামুক্ত।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, ‘এখন যে ডেঙ্গি রোগী পাওয়া যাচ্ছে, তারা মূলত, দুই সপ্তাহ আগে যে মশাগুলো পূর্ণ বয়স্ক হয়েছে তার দংশনে। আর এই মুহূর্তে ডিম থেকে মশা খুব একটা বের হবে না। এখন তো বৃষ্টি হচ্ছে, এতে পরিবেশ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ডিমগুলো তো মরে না, কোথাও গিয়ে লেগে থাকে। তবে বৃষ্টি যখন থামবে, তার এক সপ্তাহ পর থেকে দেখবেন যে ডেঙ্গুর প্রভাবটা আরো বাড়বে। আর বৃষ্টির সময়টাতে মশার উত্পাদন কম হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি তো সারা দেশে একসময় হচ্ছে না। যেখানে বৃষ্টি হচ্ছে না, সেখানে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকবে। আর বৃষ্টি যখন কমে যাবে, তার দুই সপ্তাহ পর থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকবে। যেহেতু আমাদের গ্রাম-শহর কোথাও পরিকল্পিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান হচ্ছে না, কাজেই এখানে এডিস মশার বিস্তার কমার কোনো আশা দেখছি না। ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া বৃষ্টি থামার এক মাস পর পর্যন্ত থাকবে।’

ঢাকাসহ চাপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, গাজীপুর ও চাঁদপুর এবং উপকূলের পাঁচ জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালীতে রোগীর সংখ্যা বেশি। ডেঙ্গু আক্রান্তের ৭৯ শতাংশ ও মৃত্যুর ৮৭ শতাংশ হয়েছে এসব জেলায়। উপকূলের পাঁচ জেলায় আক্রান্ত ৪৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ ও মৃত্যু ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেছেন, ডেঙ্গু এখন আর আগের মতো সহজভাবে মোকাবিলা করার মতো অবস্থায় নেই। এ রোগের ধরন বদলেছে, অনেক রোগীর অবস্থাই দ্রুত জটিল হয়ে উঠছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজনও বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে জনসচেতনতা বাড়ানো এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ ডেঙ্গু মোকাবিলায় সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, জ্বর হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে। সময়মতো চিকিত্সা নিলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরো ৩৭৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কারো মৃত্যু হয়নি। এই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে ৪০৩ জন ডেঙ্গু রোগী। গতকাল ১৭ জুলাই বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১১৬ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬১ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩৭ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪২ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৮ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) আট জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৩ জন এবং সিলেট বিভাগে এক জন রয়েছে।

এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মোট ১৬ হাজার ২৮১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৫৮.৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৪১.৩ শতাংশ নারী। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে মোট ১৫ হাজার আট জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৬০ জন।

২০২৪ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে মোট ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মারা গেছে ৫৭৫ জন।

২০২৪ সালে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৭৫ জন। এর আগের বছর, ২০২৩ সালে, রেকর্ডসংখ্যক ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের।