
গোপালগঞ্জ শহরে প্রবেশ পথেই পড়ে বিসিক ব্রিজ। গতকাল দুপুর দেড়টা। আকাশ জুড়ে মেঘ। সঙ্গে ভ্যাপসা গরম। দিনের আলো থাকলেও গোটা সড়ক যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন। জনশূন্য পথ। দিনে-দুপুরেই ভুতুড়ে পরিস্থিতি। কিছুক্ষণ পর পর সাইরেন বাজিয়ে সাঁই সাঁই করে চলাচল করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি। জরুরি প্রয়োজনে দুই-একজন মানুষকে রাস্তায় দেখা গেলেও চলাচলে একেবারেই সতর্ক। গতকাল দিনভরই এমন চিত্র দেখা গেছে গোপালগঞ্জে। টানা কারফিউ’র কারণে ভোগান্তিও ছিল সাধারণ মানুষের। কারফিউ’র কারণে জেলা শহরে দিনভর ছিল সুনসান অবস্থা। উদ্বেগ-আতঙ্ক সর্বত্র। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকে ঘর বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
বুধবার জাতীয় নাগরিক পার্টির সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হামলা ও পরে সংঘর্ষের ঘটনায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলে জেলায় ২২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। গতকাল সেই কারফিউ’র মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। শুক্রবার দিনে তিন ঘণ্টার বিরতি দিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে বলে জানানো হয়েছে।
সরজমিন দেখা যায়, বুধবার রাত আটটা থেকে শুরু হওয়া কারফিউ’র ফলে শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র সুনসান। যে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগকে আগের দিন শহরজুড়ে সহিংস অবস্থানে দেখা গেছে তাদের কাউকেই আর গতকাল শহরে দেখা যায়নি। সবাই গা ঢাকা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষও ঘরের বাইরে বের হননি। দোকানপাট ছিল বন্ধ। অলিগলিতে কিছু দোকান খোলা থাকলেও ক্রেতা দেখা যায়নি। এদিকে কারফিউ’র কারণে দোকানপাট বন্ধ থাকায় ব্যাপক ভোগান্তির মুখে পড়েছেন শহরের বাসিন্দারা। দিনের কোনো ভাগে কারফিউ’র বিরতি না থাকায় কঠোর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। বাসিন্দারা জানান, একটানা কারফিউ থাকায় দোকানপাট সব বন্ধ। ফলে জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার অবস্থাটাও তৈরি হয়নি। তারা আরও জানান, এই ধরনের পরিস্থিতি আগে খুব একটা দেখেননি। এটা তাদের কাছে নতুন এক অভিজ্ঞতা।
গোপালগঞ্জের বিভিন্ন সড়কের পাশে বাসা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুধবারের ঘটনার পর পুরো জেলায় মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বাড়ির বাইরে বের হলেই গ্রেপ্তারের ভয় কাজ করছে কম-বেশি সবার মাঝে।
গোপালগঞ্জ শহরের জেলা নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের পাশে বসবাস করা বাসিন্দা নাসিম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সকালে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু একটা রিকশা কিংবা অটো চোখে পড়েনি। নাস্তার জন্য রাস্তায় এসে দেখি কোনো দোকানপাট খোলা নেই। এমন অবস্থা আগে কখনো দেখিনি।
হাসপাতাল রোডের বাসিন্দা ফাহিম শিকদার বলেন, এ অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের বিচারের আওতায় আনা দরকার। গোপালগঞ্জ শহরে আগে কখনোই এমন পরিস্থিতি হয়নি। যারা হট্টগোল করেছে তাদের না ধরে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। সকালবেলা বেরিয়েছিলাম পুলিশ এসে তাড়া করে ঘরে ঢুকতে বলেছে।
শহরের ঘোনাপাড়া, এলজিইডি মোড়, জেনারেল হাসপাতাল, লঞ্চঘাটসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, পুলিশের চেকপোস্ট বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে শহরের পুলিশ লাইন্স মোড় থেকে বেশ কয়েকটি স্থানে সেনাবাহিনীর একাধিক গাড়ি বহর টহল দিতে দেখা গেছে।
ঘোনাপাড়া মোড়সংলগ্ন সড়কে পড়ে থাকা রেইনট্রি গাছ কাটতে দেখা যায় বাদাম বিক্রেতা রোজিনা বেগমকে। তিনি বলেন, রাতে কেউ গাছ কেটে রেখেছে, সকালে হাঁটতে বের হয়ে দেখি। সংসারের কাজে লাগবে ভেবে ডালপালা কেটে সরাচ্ছি। শহরের বিভিন্ন সড়কে পড়ে থাকা ইট-পাথর ও আগুনে পোড়া জিনিসপত্র সরাতে দেখা গেছে পৌরসভার কর্মীদের। কারফিউয়ের কারণে স্থানীয় রুটের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট, গোপালগঞ্জ-ব্যাশপুর, গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া-পয়সারহাট রুটে বাস চলেনি। তবে ঢাকাসহ দূরপাল্লার বাসগুলো চলেছে স্বাভাবিকভাবেই।
শহরের পুলিশ লাইন্স মোড় এলাকার পরিবহন শ্রমিক জুলহাস মিয়া বলেন, কারফিউয়ের কারণে রাস্তায় লোকজন নেই, তাই লোকাল গাড়িগুলো চলছে না। এখান থেকে স্থানীয় দু’টি রুটে বাস চলে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট ও গোপালগঞ্জ-ব্যাশপুর। এই দুই রুট ছাড়াও গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া-পয়সারহাট রুটেও বাস চলছে না। তবে ঢাকাসহ দূরপাল্লার যানবাহন চলছে স্বাভাবিকভাবেই। অটোচালক শাজাহান শেখ বলেন, এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে কয়টা যাত্রীর জন্য বের হয়েছিলাম তাও নাই। রাস্তায় সব বন্ধ। এখন গ্যারেজে গাড়ি রাখার জন্য যাচ্ছি। ওদিকে এনসিপি’র সমাবেশে হামলা ও পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে অভিযান চালানো হচ্ছে। ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে দায়ীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গতকাল বিকালে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয় বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
সময় বাড়লো কারফিউর: গোপালগঞ্জে কারফিউর সময় বাড়ানো হয়েছে। আজ শুক্রবার বেলা ১১টা পর্যন্ত কারফিউ বহাল থাকবে। তিন ঘণ্টা শিথিলের পর দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলার পরিস্থিতি তুলে ধরেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফউদ্দিন আহমদ চৌধুরী।
সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়, বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে চলমান কারফিউ শুক্রবার সকাল ১১টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ বন্ধ থাকবে। দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ চলমান থাকবে।
নিহত ৪ জনের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন-সৎকার সম্পন্ন: গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র সমাবেশকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত চারজনের দাফন ও সৎকার সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিহতের স্বজনরা তাদের মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছেন বলে তথ্য মিলেছে। নিহতদের মধ্যে গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহা (৩০) কে বুধবার রাতে পৌর শ্মশানে সৎকার করা হয়। টাইলস মিস্ত্রির সহকারী রমজান কাজী (১৯)কে বুধবার রাতে এশার নামাজের পর গ্রামে বাড়ি কোটালীপাড়ায় দাফন করা হয়। এ ছাড়া মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সোহেল রানা (৩৫) ও ক্রোকারিজ দোকানের কর্মচারী ইমন তালুকদারকে বৃহস্পতিবার সকালে গোপালগঞ্জ পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। নিহত রমজান কাজীর মামা মো. কলিন সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালে তারা লাশ আনতে গেলে পোস্টমর্টেম ছাড়াই তাদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়।