
হিফজুল আমিন চৌধুরী ওরফে সাদী ও মেহেদী আমিন চৌধুরী আপন দুই ভাই। তাদের মালিকানায় হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও ট্রাভেলস এজেন্সিসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠানের ৫৩টি অ্যাকাউন্টে ৪৪৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেন্দ্রিক অভিজাত রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে তাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাশাপাশি তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে ২৩ কোটি টাকা সীমান্তবর্তী ও ফরেন রেমিট্যান্স-প্রবণ ১৮টি জেলায় পাঠানোর তথ্য পেয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সংস্থাটি একজন নায়িকার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ ট্রান্সফারের তথ্যও পেয়েছে। মানি লন্ডারিংয়ে একজন ব্যাংক কর্মকর্তারও যোগসাজশ রয়েছে।
আলোচিত দুই ভাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে—হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রেস্টুরেন্ট ‘হ্যালো স্পাইসেস কিং’, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘কনভয় সার্ভিসেস’, ‘ঈগল সার্ভিস’, ‘দ্য টাইগার ট্রেইল লিমিটেড’, ‘উত্তরা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস’, ‘এসএসএল-কনভয় জেভি’, ‘হোটেল নর্দান’, ‘মেসার্স লাকী টেক্সটাইল মিলস’, ‘পর্যটন শিল্প সমবায় সমিতি’, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন লিমিটেড’, ‘মুক্তা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’ ও ‘সিনার্জী ওয়েভ ফ্যাশন’।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ী হিফজুল আমিন চৌধুরী ও ব্যাংক কর্মকর্তা রাহাত শামস মানি লন্ডারিং অপরাধে জড়িত বলে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হয়। অনুসন্ধান ও ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় তাদের অস্বাভাবিক সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়গুলো উঠে আসে।
বিএফআইইউ’র তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, হিফজুল আমিন চৌধুরী ও মেহেদী আমিন চৌধুরীর ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের পরিচালক ও ব্যাংক আল ফালাহর হেড অব রিটেইলের সঙ্গে লেনদেন, ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ও ব্যবসায়ীদের হিসাবে পাঠানো হয়েছে প্রচুর টাকা। তাদের ‘স্পাইসেস কিং লিমিটেড’ নামের রেস্টুরেন্টে বিদেশি বিনিয়োগ থাকলেও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেওয়ার বিষয়ে ব্যাংকগুলোতে কোনও তথ্য নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব থেকে দেশের সীমান্তবর্তী ও রেমিটেন্স-প্রবণ এলাকায় বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠানো হয়েছে। এসব বিষয়ে অনুমান করা যায়—তারা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচার করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে দুই ভাই হিফজুল আমিন চৌধুরী ওরফে সাদী ও মেহেদী আমিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনও মন্তব্য করেননি। বরং একজন প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আলোচিত এই দুই ভাই আওয়ামী লীগের আমলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রভাবে চলাফেরা করতেন। বিএফইআই’র এই প্রতিবেদন অনুযায়ী পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম শাখা তদন্তও শুরু করেছিল। অভিযোগ রয়েছে, সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলীকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে তদন্ত বন্ধ রেখেছিলেন তারা। সম্প্রতি সিআইডির সংশ্লিষ্ট বিভাগ পুনরায় তদন্তের প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিএফআইইউ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১৯টি ব্যাংক এবং একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৫৩টি হিসাব রয়েছে তাদের। এসবের মধ্যে বর্তমানে সচল রয়েছে ৩৫টি হিসাব। এর মধ্যে স্পাইসেস কিংয়ের ১৬টি, কনভয় সার্ভিসের ২৮টি ও ঈগল সার্ভিসের নামে ৯টি হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবে ৪৪৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা জমা হয়েছে। হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ৪৪৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠান কনভয় সার্ভিসের ব্যাংক হিসাব থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা— ফেনী, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, রংপুর, বরিশাল, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, সিলেট, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৭ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় কাপড় ব্যবসায়ী ও সাতক্ষীরায় ইউনিসেফের এক প্রজেক্ট কর্মকর্তার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে এসব লেনদেন সামঞ্জস্যহীন। এছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে একইসঙ্গে বিপুল সংখ্যক হিসাব খোলা ও বিপুল পরিমাণ লেনদেনে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হিফজুল আমিন চৌধুরী ও মেহেদী আমিন চৌধুরীর নামে ঢাকা ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে দুটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তাদের মালিকানাধীন ‘কনভয় সার্ভিস’ ও ‘স্পাইসেস কিং’ থেকে নিয়মিত এই দুটি ব্যক্তিগত হিসাবে অর্থ জমা করা হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক আল ফালাহ’র কর্মকর্তা (হেড অব রিটেইল ব্যাংকিং) রাহাত শামসের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ডাবল গ্লেজড লিমিটেডের’ হিসাবে হিফজুল আমিন চৌধুরীর ব্যক্তিগত হিসাব থেকে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে। এসব লেনদেন ছিল অস্বাভাবিক।
ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হিফজুল আমিন চৌধুরীর ব্যক্তি নামে ২২টি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। তার ছোট ভাই মেহেদী আমিন চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব রয়েছে ১৬টি। এর মধ্যে হিফজুল আমিন চৌধুরীর ঢাকা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ১১ কোটি ২৩ লাখ টাকা জমা করা হয়েছে। তবে এই অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় পুরো টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এই অ্যাকাউন্টে ৫ কোটি ২ লাখ টাকা জমা হয়েছিল তাদের মালিকানাধীন স্পাইসেস কিং থেকে। ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মূলত অ্যাকাউন্টটিতে লেনদেন করা হয়। জমা হওয়া অর্থের একটি বড় অংশ ট্রান্সফার করা হয়েছে ‘সাব্বির রেন্ট-এ কার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে।
হিফজুল আমিন চৌধুরীর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ব্যাংক হিসাবটিতে ২৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা জমা হয়েছে। আবার প্রায় সমুদয় টাকাই তুলে নেওয়া হয়েছে। এই অ্যাকাউন্টে ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং ইন-হাউজ চেকে ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে জমা হওয়া ৬ কোটি ৪১ লাখ টাকার বেশির ভাগই জমা হয়েছে তার মালিকানাধীন কনভয় সার্ভিস ও ঈগল সার্ভিসের অ্যাকাউন্ট থেকে। উত্তোলন হওয়া অর্থের মধ্যে ৫০ লাখ টাকা হিফজুল আমিন চৌধুরীর স্ত্রী আনিসা জাফর চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিফজুল আমিন চৌধুরী ও মেহেদী আমিন চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কনভয় সার্ভিস ও স্পাইসেস কিং থেকে তাদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে নিয়মিত অর্থ জমা করা হয়েছে। এভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে ব্যক্তি অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেওয়া হয়। কন্সট্রাকশন ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাবেও অর্থ সরানো হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে অর্থ এনে স্ত্রীকেও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া টেক্সটাইল ব্যবসায়ী ও ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের পরিচালক একিউএম ফয়সাল আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে লেনদেন এবং কর্মকর্তা রাহাত শামসের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডাবল গ্লেজড লিমিটেডের হিসাবে অর্থ পাঠানোর ঘটনাও অস্বাভাবিক। এসব বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
কর ফাঁকির অর্থ দিয়ে ফ্ল্যাট কেনায় বিনিয়োগ করার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, হিফজুল আমিন চৌধুরী ও তার ভাই মেহেদী আমিন ডিবিএইচ থেকে ঋণ নিয়ে চারটি ফ্ল্যাট কেনেন। তবে নির্ধারিত সময়ের ১৩ বছর আগেই ২০২০ সালের ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। ঋণের মেয়াদ পূর্তির আগেই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তা পরিশোধ করা মানি লন্ডারিং অপরাধের অন্যতম নির্দেশক।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্পাইসেস লিমিটেডে জুবায়ের আহমেদ ও জেরিনতাজ আহমেদ নামে দুই জন প্রবাসীর ৭৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আয় থেকে কীভাবে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে সেটি স্পষ্ট না। প্রতিষ্ঠানটিতে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন ও আইরিন আমিন উদ্দিনের বিনিয়োগ রয়েছে। স্পাইসেস লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান থেকে হিফজুল আমিন চৌধুরী ও মেহেদী আমিন চৌধুরীর যৌথ ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কনভয় সার্ভিসের ঋণ সমন্বয়ের জন্য ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে স্পাইসেস লিমিটেডের শেয়ার হোল্ডারদের কীভাবে অর্থ দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কোনও তথ্য নেই।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এসব অর্থ পাচারের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠান ঈগল সার্ভিসের নামে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আড়াই বছরে ৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা সীমান্তবর্তী এলাকা যশোরের বেনাপোল, ইনকামিং রেমিট্যান্স-প্রবণ এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও মাদারীপুরসহ আরও ১৮টি জেলা পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া ঈগল সার্ভিসের নামে ডাচবাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে সরবরাহকারী, ফুড ক্যাটারিং সার্ভিস, পরিবহন ব্যবসা ও প্রথম শ্রেণির ঠিকাদারি ব্যবসা হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে হিসাবটিতে সম্পাদিত লেনদেন পর্যালোচনা দেখা গেছে—একটি সিগারেট উৎপাদনকারী ও বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত দুটি সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট থেকে ১৩৭টি লেনদেনের মাধ্যমে ঈগল সার্ভিসে ৩২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা জমা হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠান হলেও অর্থ লেনদেন স্বাভাবিক না।