
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তার স্ত্রী ও দুই কন্যার নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দালিলিকভাবে তারিক সিদ্দিক পরিবারের এসব সম্পদের মূল্য ৬২ কোটি টাকা বলা হলেও বাস্তবমূল্য কয়েকশ কোটি টাকা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুদকের অনুসন্ধানে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নামে ২৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ মিলেছে। তার স্ত্রী শাহিন সিদ্দিকের নামে ২৫ কোটি ৭৭ লাখ এবং সিদ্দিক দম্পতির দুই মেয়ে নূরিন তাসফিয়া সিদ্দিক ও বুশরা সিদ্দিকের নামে যথাক্রমে তিন কোটি ৩৭ লাখ ও চার কোটি তিন লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সবমিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রায় ৬২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়ায় পৃথক মামলার সুপারিশ করতে যাচ্ছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। এছাড়া তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও তার স্ত্রী শাহিন সিদ্দিকের ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১২২ কোটি টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের প্রমাণ মিলেছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদকের অনুসন্ধান ও মামলা সম্পূর্ণ দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে হয়। যেকোনো আসামির বিরুদ্ধে সম্পদের অভিযোগ আনা হয় দলিলের লেখা মূল্য অনুসারে, যা বাস্তব মূল্য থেকে অনেক কম। তারিক পরিবারের যে সম্পদ পাওয়া গেছে তার বাজার মূল্য ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। তবে, দুদককে যেহেতু আদালতে প্রমাণ করতে হবে তাই দালিলিক মূল্যই বিবেচনা করা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নামে ২৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ মিলেছে। তার স্ত্রী শাহিন সিদ্দিকের নামে ২৫ কোটি ৭৭ লাখ এবং সিদ্দিক দম্পতির দুই মেয়ে নূরিন তাসফিয়া সিদ্দিক ও বুশরা সিদ্দিকের নামে যথাক্রমে তিন কোটি ৩৭ লাখ ও চার কোটি তিন লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে
অন্যদিকে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তারিক সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুদকের একাধিক অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। তিনি দুদকের একাধিক মামলার আসামি। তার (তারিক আহমেদ সিদ্দিক) পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেলে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তারিক সিদ্দিক পরিবারে যত সম্পদ
দুদকের অনুসন্ধানে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সম্পদের মধ্যে রয়েছে বারিধারা ডিওএইচএসের ১ নম্বর রোডে ৭তলা বাড়ি, গুলশানে তিনটি ফ্ল্যাট বাড়ি যা তিনি মায়ের কাছ থেকে পাওয়া বলে দেখিয়েছেন। রয়েছে পূর্বাচল ৭ নম্বর সেক্টরে প্লট। এছাড়া ব্যাংকে তার নগদ ১৭ কোটি ৩৬ লাখ ৫১ হাজার টাকার তথ্য মিলেছে।
তার স্ত্রী শাহীন সিদ্দিকের নামে পূর্বাচল নতুন শহরে সেক্টর- ২১ ও ৩০ নম্বরে তিনটি প্লট, পূর্বাচলের ২৬ নম্বর সেক্টরে ১০ কাঠার একটি ও পাঁচ কাঠার আরও দুটি প্লট, বারিধারা মডেল টাউনে সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট, বারিধারা ডিওএইচএসে প্রায় তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট এবং ব্যাংকে দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকার এফডিআরসহ তিন কোটি ৬৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা তথ্য মিলেছে।
তবে, মেয়েদের নামে কোনো স্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়নি। অবৈধ সম্পদ হিসাবে আট কোটি টাকার বেশি সম্পদের পুরোটা অস্থাবর ও নগদ অর্থ। এসব সম্পদ তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত হলেও কোনো গ্রহণযোগ্য আয়ের সন্ধান মেলেনি।
যা বলছে দুদকের অনুসন্ধান
দুদকের অনুসন্ধানের রেকর্ডপত্র ও তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তারিক আহমেদ সিদ্দিকের স্থাবর ও অস্থাবরসহ সর্বমোট সম্পদের পরিমাণ মিলেছে ৪৩ কোটি ৬৩ লাখ ৬১ হাজার ৬৩৬ টাকা। এর বাইরে ব্যয়ের পরিমাণ পাঁচ কোটি এক লাখ ৪২ হাজার ৭৬৫ টাকা। অর্থাৎ ব্যয়সহ তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ কোটি ৬৫ লাখ চার হাজার ৪০১ টাকা।
অনুসন্ধানে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ১৫ কোটি ৮৫ লাখ ৪১ হাজার ১৬৯ টাকা। এর সঙ্গে দায়-দেনা যোগ করলে গ্রহণযোগ্য আয় দাঁড়ায় ২০ কোটি পাঁচ লাখ ৪১ হাজার ১৬৯ টাকা। অর্থাৎ ২৮ কোটি ৫৯ লাখ ৬৩ হাজার ২৩২ টাকা অনুসন্ধানকালে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। দুদক মনে করে, তারিক আহমেদ সিদ্দিক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত থাকাকালে তার ওপর অর্পিত সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, যা দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ২০০৪-এর ৫ (২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তারিক সিদ্দিকের স্ত্রী শাহীন সিদ্দিকের নামে পূর্বাচল নতুন শহরে সেক্টর- ২১ ও ৩০ নম্বরে তিনটি প্লট, পূর্বাচলের ২৬ নম্বর সেক্টরে ১০ কাঠার একটি ও পাঁচ কাঠার আরও দুটি প্লট, বারিধারা মডেল টাউনে সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট, বারিধারা ডিওএইচএসে প্রায় তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট এবং ব্যাংকে দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকার এফডিআরসহ তিন কোটি ৬৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা তথ্য মিলেছে
এছাড়া তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নামে চারটি ব্যাংক হিসাবে সর্বমোট ৬২ কোটি ৬০ হাজার ৯৮৪ টাকার সন্দেহভাজন লেনদেন পাওয়া গেছে। বর্তমানে তার ব্যাংক হিসাব থেকে ৫০ লাখ ৮১ হাজার ৩৬২ টাকা ফ্রিজ করেছে দুদক।
তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭ (১) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
একইভাবে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের স্ত্রী শাহিন সিদ্দিকের স্থাবর ও অস্থাবরসহ সর্বমোট সম্পদ পাওয়া গেছে ৩৬ কোটি ৫৭ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৮ টাকা। ব্যয় ছয় কোটি ৭২ লাখ দুই হাজার ৫৪০ টাকা বিবেচনায় নিয়ে তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ কোটি ৩০ লাখ এক হাজার ৫২৮ টাকা। দুদকের অনুসন্ধানে তার গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ১৭ কোটি ৫৩ লাখ আট হাজার ৮৬১ টাকা। অর্থাৎ ২৫ কোটি ৭৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকার সম্পদ অনুসন্ধানকালে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। এছাড়া শাহিন সিদ্দিকের নামে ১১টি ব্যাংক হিসাবে ৫৯ কোটি ৩৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকার সন্দেহভাজন লেনদেন পাওয়া গেছে।
গত ২৭ জানুয়ারি তিন বিমানবন্দরের চার উন্নয়ন প্রকল্পের ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মহিবুল হক এবং বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমানসহ ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার মামলা দায়ের করে দুদক। প্রতিটি মামলায় তারিক আহমেদ সিদ্দিককে আসামি করা হয়েছে
এই দম্পতির মেয়ে নূরিন তাসফিয়া সিদ্দিকের বিরুদ্ধে তিন কোটি ৩৭ লাখ ১৭ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যা তার বাবা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের অবৈধ সম্পদেরই অংশ হিসেবে মনে করছে দুদক। তাদের আরেক মেয়ে বুশরা সিদ্দিকেরও স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে চার কোটি দুই লাখ ৯৭ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ মিলেছে।
গত ২৭ জানুয়ারি তিন বিমানবন্দরের চার উন্নয়ন প্রকল্পের ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মহিবুল হক এবং বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমানসহ ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার মামলা দায়ের করে দুদক। প্রতিটি মামলায় তারিক আহমেদ সিদ্দিককে আসামি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিগত ১৫ বছরে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে উন্নয়ন কাজের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও আত্মসাতের অভিযোগে তারিক আহমেদ সিদ্দিক, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মহিবুল হক এবং বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমানসহ শীর্ষ আট কর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। অনুসন্ধান পর্যায়ে তাদের তলবও করা হয়েছিল। তবে, কেউ দুদকে হাজির হননি।