Image description

ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার তরুণ আলেম হাফেজ মাওলানা মুফতি মাহমুদুল হাসান মাহদী (২৫)। নিহত মাহদী সরাইলের পাকশিমুল ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ছিলেন গ্রামের হাফেজ আব্দুস সাত্তারের বড় ছেলে।

সকালে মসজিদ থেকে বাসায় ফিরেই মাকে জানিয়েছিলেন, বাইরে যাবেন। মা অনেক অনুরোধ করেও রাখতে পারেননি। গিয়েছিলেন সবার ন্যায়ের লড়াইয়ে। কিন্তু আর ফেরেননি।

সেই ৫ আগস্টের কথা। ঢাকার উত্তরা—বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি। আন্দোলন চলাকালেই হঠাৎ পুলিশের ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হন মাহদী। একটি গুলি এসে লাগে তার বাম বুকে। রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন সড়কে। উপস্থিত লোকজনই তখন দৌড়ে নিয়ে যান কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানান, তিনি আর নেই।

ঢাকার বারিধারা মাদ্রাসা থেকে হেফজ শেষ করে পড়েছেন মালিবাগের বিখ্যাত মাদ্রাসায়। সেখানেই ইফতা বিভাগে পাঠ শেষ করেন। এরপর গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার এক মসজিদে পেশ ইমাম হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কণ্ঠে ছিল সুন্দর ক্বিরাত, মনের ভেতর গভীর দেশপ্রেম।

দুই বছর আগে বিয়ে করেছিলেন পাশের গ্রামের তরুণী বুশরাকে। তাদের ঘরে এসেছে একটি পুত্রসন্তান, এখন বয়স মাত্র ৯ মাস। নাম রেখেছেন উজায়ফা। স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে থাকতেন শ্বশুরবাড়ি আব্দুল্লাহপুরে। মাঝেমধ্যে যেতেন গ্রামের বাড়ি ফতেহপুরে, বাবা-মায়ের খোঁজ নিতে।

পরদিন ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় যখন অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়ি আসে শহীদের মরদেহ, তখন শুধু কান্নার ধ্বনি। কোনো ভাষা ছিল না পরিবার-পরিজনের চোখে-মুখে। ৭ আগস্ট জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে।

ছেলে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন পিতা হাফেজ আব্দুস সাত্তার। বললেন, ‘অনেক কষ্ট করে হাফেজ বানিয়েছিলাম, মাওলানা বানিয়েছিলাম, মুফতি বানিয়েছিলাম। বুকের মধ্যে গুলি করার সময় পুলিশের হাতে একটুও কাঁপুনি ধরল না। সে ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র ভরসা। এখন আমার নাতি, পুত্রবধূসহ সবাই অনিশ্চয়তার মধ্যে।’

আর সেই দুঃসংবাদের আঘাত সইতে না পেরে কিছুদিন পর স্ট্রোক করেন তিনি। এখন পুরোপুরি শয্যাশায়ী। সংসারে আর কেউ উপার্জনক্ষম নেই। তাই নেমে এসেছে ভয়াবহ আর্থিক সংকট।

শহীদ মাহদীর মা বলেন, ‘আমার স্বামী ছিলেন এক মসজিদের ইমাম, ছেলে ছিল আরেক মসজিদের ইমাম। এই দু’জনের সামান্য আয়ে আমাদের ৮ জনের সংসার চলত। এখন ছেলেকে হারালাম, স্বামীও অসুস্থ। সংসার চলছে না, চিকিৎসা চলছে না। সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে।’

মাহদীর শহীদ হওয়ার পর শুরুতে কিছু সংগঠন যেমন—জুলাই ফাউন্ডেশন, হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু এরপর কেউ আর ফিরে তাকায়নি।

মুফতি মাহদীর মা রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা খুবই অসহায় অবস্থায় আছি। ছেলে ছিল পরিবারটার চালিকাশক্তি। এখন ঘরে খাবার নেই, চিকিৎসার টাকা নেই। যদি সরকার পাশে দাঁড়ায়, কিছুটা আশার আলো দেখতে পারতাম।’

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।