
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলের একটি নবনির্মিত ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সঞ্জু বরাইক। আজ সোমবার (১৪ জুলাই) ভোরে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। মাত্র চতুর্থের বর্ষের ছাত্র সঞ্জু। সহপাঠীদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রেমঘটিত কারণে হতাশ হয়ে এ মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
সঞ্জুর ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়। গত আড়াই মাসে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। একজন শিক্ষার্থীর জীবন যেখানে সম্ভাবনায় ভরপুর হওয়ার কথা, সেখানে বারবার কেন এমন মৃত্যুর খবরে ভারী হয়ে উঠছে ক্যাম্পাস?
আত্মহত্যা প্রতিরোধমূলক সংগঠন ‘অ্যান্টি সুইসাইডাল স্কোয়াড’-এর প্রতিষ্ঠাতা কাবিল সাদি বলেন, “ফ্যামিলির সমস্যা, প্রেমঘটিত টানাপড়েন, আর্থিক সংকট—প্রধানত তিনটি মূল কারণ এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঢাকায় পড়তে আসা অনেক শিক্ষার্থীই আর্থিকভাবে দুর্বল। এই বাস্তবতা সামলাতে গিয়ে অনেকেই ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েন।”
তিনি আরও বলেন, “অনেক শিক্ষার্থী তাদের হতাশা ও হীনমন্যতার কথা কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারেন না। একাকীত্ব বাড়ে। আবার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার সাহস বা সচেতনতাও অনেকের নেই। এসব জটিলতা থেকে বের হতে না পেরে তারা চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রাফিদ বিন ইসলাম বলেন, “কখনো কখনো মানুষ এতটাই ভেতরে ভেঙে পড়েন যে, সামান্য কারণেও বড় রকমের আঘাত পান। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করেন। তখন আত্মহত্যাকে জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ বলে মনে হয়।”
তিনি মনে করেন, বিশেষ করে কৈশোর পেরিয়ে যে যুব বয়স—সেই সময়টা সবচেয়ে সংকটময়। আত্মপরিচয়, সম্পর্ক, ক্যারিয়ার, পারিবারিক চাপ—সব মিলিয়ে মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখা অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শান্তা তাওহিদা বলেন, “শুধু একাডেমিক ফলাফল নয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর মধ্যেই নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক সেমিনার, কর্মশালা আয়োজন করতে হবে।”
শান্তা তাওহিদা বলেন, “শুধু একাডেমিক ফলাফল নয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর মধ্যেই নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক সেমিনার, কর্মশালা আয়োজন করতে হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা মাথা ধরলে যেমন গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করি, তেমনি মন খারাপ বা হতাশাও চিকিৎসার দাবি রাখে। কোনো শিক্ষার্থীর আচরণে পরিবর্তন দেখলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতাশার ইঙ্গিত পেলে, তার পাশে দাঁড়াতে হবে। কথা বলতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে।”
পরিবারের ভূমিকার কথা তুলে ধরে শান্তা তাওহিদা বলেন, “অনেক তরুণ নিজেদের আলাদা জগৎ বানিয়ে ফেলে। বাবা-মার সঙ্গে জেনারেশন গ্যাপ বাড়ে। অথচ সন্তান কাছে থাকুক বা দূরে—প্রতিদিন মা-বাবার উচিত তাদের খোঁজ নেওয়া, কথা বলা। এতে সন্তান বুঝবে, কেউ তার পাশে আছে।”
তিনি আরও বলেন, “সব শিক্ষার্থীর চাপ নেওয়ার ক্ষমতা এক রকম নয়। শিক্ষকদেরও খেয়াল রাখতে হবে—তারা যেন অতিরিক্ত পড়ালেখার চাপ দিয়ে কোনো শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে ভেঙে না ফেলেন।”
উল্লখ্য, জগন্নাথ হলের আজকের ঘটনার মাত্র ৩ দিন আগে (১১ জুলাই) ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ তারেক ওয়াদুদ নাহিদ আত্মহত্যা করেন। স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার দুই দিন পর এ ঘটনা ঘটে। দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর মিরপুর-১ এলাকার ভাড়া বাসায় নিজ কক্ষে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ পাওয়া যায়।
তারও একদিন আগে বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জান্নাতুল ফেরদৌসি টুম্পা নামে এক ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান ধ্রুবর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয় রাজধানীর মেরুল বাড্ডার বাসা থেকে।
১১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ (২৪) আত্মহত্যা করেছেন বলে জানায় তার পরিবার। গত ৬ মে শিহাবুল ইসলাম (২৪) নামে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের আত্মহত্যার খবর মানে শুধু একটি প্রাণহানি নয়, বরং আমাদের সমাজব্যবস্থার, শিক্ষা কাঠামোর ও পারিবারিক যোগাযোগের কোথাও গভীর ত্রুটি। সময় এসেছে এসব বিষয়ে জোরালো উদ্যোগ নেওয়ার—ক্যাম্পাসে নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, পরিবারে সচেতন যোগাযোগ, আর একে অন্যের প্রতি সহানুভূতির চর্চা এখন সবচেয়ে জরুরি।