
সবার সামনে পিটিয়ে হত্যা , পাথরে শরীর থেঁতলে দেওয়া , নিজের বাড়ির সামনে গুলি করে পায়ের রগ কেটে হত্যা , অস্ত্র দেখিয়ে সর্বস্ব ছিনতাই , চাঁদা না পেয়ে গুলি — এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা কয়েক দিন ধরে বেশ আলোচিত । কিন্তু পুলিশ অনেকটাই নির্বিকার । প্রতিটি ঘটনার সিটিটিভি ফুটেজ থাকলেও সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ । অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ মাসেও দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না । এতে করে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নাগরিকেরা ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো শক্তিশালী ভূমিকা না রাখায় অপরাধের মাত্রা বাড়ছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা । অন্যদিকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা মাঠে থাকলেও তাঁদের দৃশ্যমান তৎপরতা সেভাবে দেখা যাচ্ছে না । এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ( আইজিপি ) বাহারুল আলম । তিনি বলেছেন , রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়ন অসম্ভব ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন , এখন থানাগুলোয় একধরনের ভীতি কাজ করে । কথায় কথায় থানা ঘেরাও হচ্ছে । অনেক সময় দোষ না থাকলেও দাবির মুখে পুলিশ সদস্যদের বদলি করে দেওয়া হচ্ছে । ফলে কেউ নিজ থেকে কিছু করতে চান না । নিরাপদে দিন পার করার দিকেই সবার নজর । ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও কাউকে জোর করে কিছু করাতে পারছেন না । অনেক ক্ষেত্রে কোনো ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের পক্ষে বাহিনী কথা বলছে না । এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব সহজে বদলাবে না ।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে , ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে যত মানুষ খুন হয়েছিল , চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে তার থেকে ৩৮৭ জন মানুষ বেশি খুন হয়েছে । এই সময়ে পুলিশ সদস্যদের লাঞ্ছিত করার ঘটনাও বেড়েছে । আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন , জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো এখন নিজেদের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করবে , এটাই স্বাভাবিক । তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়গুলোকে কীভাবে তা হ্যান্ডেল করছে , সেটিও দেখার বিষয় । পুলিশ ঠিকমতো কাজ না করলেও সেনাবাহিনীর তো ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আছে , তারা এখন কী করছে , সেদিকেও নজর দেওয়ার বিষয় আছে । রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বাহিনীগুলোকে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে বলে মত দিয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ ।
আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন , পুলিশের মনোবল এখনো ফিরে আসেনি , তাদের আরও বুস্ট করার দরকার আছে । তাহলে তারা আরও ভালো কাজ করতে পারবে । তবে তারা আগের থেকে একটু অ্যাকটিভ হয়েছে । পুলিশ কেন আলোচিত সব ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে না , তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা । নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন , রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় অনেক সময় আসামি ধরেও আটকে রাখা যায় না । কিছু ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চ মহল থেকেও এসব বিষয়ে নির্দেশনা আসে ।
তিনি বলেন , পুলিশের অনেক সদস্যও এখন কাজে নামতে দ্বিধায় ভুগছেন । কারণ , অনেকের মধ্যে এখনো আক্রমণের শিকার হওয়ার আতঙ্ক রয়ে গেছে । সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত কিছু ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ । পুলিশ সূত্র জানায় , কিছু কিছু ঘটনা রেকর্ড রেখেই সবার সামনে আনা হচ্ছে । কোনো কোনো রাজনৈতিক দল অস্থিরতা বাড়াচ্ছে কি না , সেই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে । কারণ , তাড়াতাড়ি নির্বাচন আয়োজন এবং নির্বাচন পেছানোর দুই দাবিই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে । ফলে পুলিশকেও এসব হিসাবে রেখে কাজ করতে হচ্ছে ।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন , নির্বাচন নেই বলে আজকে দেশে এই ঘটনাগুলো ঘটছে , আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে , মৃত্যু বাড়ছে , দুর্বত্তরা সুযোগ নিচ্ছে । একটা নির্বাচিত সরকার এলে নিঃসন্দেহে সেটা শক্তিশালী সরকার হবে । জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন , অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রশাসন পুনরায় সংগঠিত হতে সময় নিচ্ছে । পুলিশকে কার্যকরভাবে কাজে ফেরানো এবং অপরাধ দমন দুটিই একই সঙ্গে চালানো চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে ।
তিনি আশাবাদী , শিগগির পরিস্থিতির উন্নতি হবে । তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়ন অসম্ভব বলে মনে করেন আইজিপি । অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন , চুরি , ছিনতাই , মব সহিংসতাসহ সব ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে । পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যেকোনো সময় চিহ্নিত অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের ধরতে বিশেষ বা চিরুনি অভিযান পরিচালনা করতে পারে ।
আলোচিত ঘটনায়ও সব আসামি গ্রেপ্তার নেই গত বুধবার ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে বিকেলে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে কুপিয়ে এবং পাথর মেরে হত্যা করা হয় ।
গত বৃহস্পতিবার খুলনার দৌলতপুরে যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে নিজ বাড়ির সামনে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা । গত শুক্রবার চাঁদপুরে মসজিদের ভেতরেই কোপানো হয় ইমামকে । একই দিনে ঢাকার শ্যামলীতে ছিনতাইকারীরা এক যুবকের পরনের কাপড় ও স্যান্ডেল পর্যন্ত নিয়ে যায় । আর পল্লবীতে এক আবাসন প্রতিষ্ঠানে চাঁদা না পেয়ে গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা । গত সাত দিনে সংঘটিত এসব ঘটনার বেশির ভাগেরই সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ্যে এসেছে । এরপরও সব আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ । এসব ঘটনায় আসামিদের গ্রেপ্তার নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারাও ।
জানতে চাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন , বাহিনীগুলো শক্তিশালী কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না । অপরাধীরা জানে তারা আইনের আওতায় আসবে না , তারা ছাড় পাবে — এই বিশ্বাস থেকেই তারা অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে । অপরাধ বেড়েছে কতটা পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী , ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে সারা দেশে ১ হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছে । প্রতি মাসেই খুনের সংখ্যা বেড়েছে । জানুয়ারিতে ২৯৪ জন , ফেব্রুয়ারিতে ৩০০ জন , মার্চে ৩১৬ জন , এপ্রিলে ৩৩৬ জন , মেতে ৩৪১ এবং জুন মাসে ৩৪৪ জন মানুষ খুন হয়েছে । এ ছাড়া গত ছয় মাসে সারা দেশে ৩৬৬ টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে । চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৩৮ টি । এই সময়ে ৫১৬ জন অপহরণ , ৩২৯ জন পুলিশ লাঞ্ছিত এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের ১১ হাজার ৮ টি ঘটনা পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে । অন্যদিকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে সারা দেশে ১ হাজার ৫৪৩ জন খুন এবং ২৮১ জনকে অপহরণ করা হয় । এই সময়ে ২৮১ জন পুলিশ সদস্য লাঞ্ছিত হন এবং ৬৮৮ টি ডাকাতি ও ৪ হাজার ৭১৭ টি চুরির ঘটনা ঘটে । এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতনের ৯ হাজার ২ টি ঘটনা পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে ।