Image description

দেশে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড বাড়ছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর থেকে এর হার তুলনামূলক বেড়েছে। বিভিন্ন স্থানে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করছে বিক্ষুব্ধ লোকজন। আবার রাজনৈতিক সহিংসতাও বেড়েছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। দখল, চাঁদাবাজি, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক বিরোধ ও পারিবারিক কলহ থেকে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সময়ে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হওয়া পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেছে ফ্যাসিবাদ পতনের পরপরই। এর মধ্যে দুর্বৃত্তরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ ত্বরিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এতে বাড়ছে অপরাধের মাত্রা। রাতের বেলায় পুলিশের টহল কমে যাওয়ায় অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ‍ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, গত সাড়ে ৬ মাসে সারা দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ৯৪ জনের। আর শুধু ঢাকায় গত ৬ মাসে খুন হয়েছে ১৯০ জন। দিন দিন এই নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। খুনের পাশাপাশি ছিনতাইও বেড়েছে।

গত বুধবার মিটফোর্ড হাসপাতালের ভেতরের ৩ নম্বর গেটের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে পাথর দিয়ে হত্যার ঘটনা সারা দেশের বিবেকবান মানুষকে নাড়া দিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে পরিবর্তন এসেছে। পুলিশের ট্রমা এখনো কাটছে না। এতে পুলিশ আগের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারছে না। অভিযানে যেতেও ভয় পাচ্ছে। রাতের বেলায় টহল দিতে পারছে না।

তবে পুলিশ বলছে, অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশ আন্তরিকভাবে কাজ করছে। যদি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলোতে পুলিশ প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় এসেছে।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আমার দেশকে বলেন, চলমান নানা সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় পুলিশ যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে দেরি করছে। এই দেরির কারণে অপরাধীরা অপরাধ করার সুযোগ পাচ্ছে। একই সঙ্গে অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশের সংশয় রয়েছে। তিনি আরো বলেন, অন্যদিকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে পুলিশ কখনো নিরাপত্তা সংকট বা হুমকির মধ্যে পড়ছে। আবার উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রেক্ষাপটে পুলিশ নিজেরাই ব্যবস্থার মুখোমুখি হচ্ছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিসিটি) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। অপরাধ প্রতিরোধে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো কার্পণ্য নেই। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় নয়।’ তিনি আরো বলেন, পুলিশের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের সব সচেতন নাগরিকের উচিত এ বিষয়ে ভূমিকা রাখা। পারস্পরিক সহনশীলতা, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অপরিহার্য এবং এর কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি সমাজে যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তাহলে আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে পুলিশকে জানানো উচিত। আমরা তাৎক্ষণিক আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’

জানা গেছে, গত বুধবার মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের সামনে সোহাগকে হত্যার পর সারা দেশে আবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়টি উঠে এসেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বারবার বলা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তারা কাজ করছেন। এর মধ্যে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের থানা ও জনসাধারণের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না।

বুধবার মিটফোর্ডে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে। তার শরীরে পাথর মেরে হত্যা নিশ্চিত করে খুনিরা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা লোকজন চেয়ে চেয়ে দেখেছেন, কেউ ভিডিও করেছেন কিন্তু তাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি। কয়েক দিন আগে চাঁদপুরের একটি মসজিদে জুমার নামাজ শেষে মসজিদের ভেতরেই কুপিয়ে জখম করা হয় ইমাম মাওলানা নূর রহমান মাদানীকে। জুমার নামাজের খুতবার সময় ইমামের দেওয়া বক্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা চালায় বিল্লাল হোসেন নামের একজন।

গত ৩ জুলাই সকালে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে দুই নারীসহ তিনজনকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। খুলনার দৌলতপুরে নিজ বাসার সামনে যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে তার বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, পুলিশের টহল আগের চেয়ে কমে গেছে। আসামি ধরতে পুলিশ ভয় পাচ্ছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আসামি ধরতে গিয়ে পুলিশ হামলার শিকার হচ্ছে। এছাড়া রাতে পুলিশ টহল দিতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত রয়েছে। পাশাপাশি মামলার তদন্ত করার জন্য আগে থানার একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ঘটনাস্থল ও ভিকটিমের বাসায় যেতেন। সেটিও ৫ আগস্টের পর কমে গেছে। রাতের টহলে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ জন পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় ডিউটি করতেন। সেটিও এখন কমে গেছে।

তবে সচেতন মহলের দাবি, বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামি ধরতে পুলিশের কচ্ছপগতি লক্ষ করা গেছে। এতে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।